নিজস্ব সংবাদদাতা: কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সুবর্ণরৈখিক প্রাচীন উৎসব 'পৈড়ান'। "পৈড়ান" গ্রামবাংলার বিশেষ করে জঙ্গলমহলে তথা সুবর্ণরেখা অববাহিকার একটি প্রাচীন লৌকিক উৎসব। কালীপূজার পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হারিয়ে যাওয়া এই উৎসব কে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিবছর এই সময় ধুমধাম করে পালিত হয় জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রামের জুনশোলা গ্রাম সহ জঙ্গলমহলের একাধিক এলাকায়।
মূলত ফসলের সমৃদ্ধির জন্য এই উৎসব করা হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। এই লৌকিক উৎসব তথা লৌকিক ক্রীড়ায় কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের শক্তি পরীক্ষার কাজও চলে। আগের দিনে প্রায় সব বাড়িতে কৃষক পরিবার বিশেষ করে কৃষক পরিবারের বাড়ীর উঠানে "পৈড়ান গাড়া" হত আর তা সাজানো হত নানান ফুল দিয়ে। লাগানো হত "পিঠালী বাটা” বা “পিটুলী”।
এর পর আতপচাল, হরিতকি, দূর্বাঘাস, সিঁদুর, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। অনেকটা লম্বা পাটের গোছাকে চুলের বিনুনী মতো করা হয় এবং সেটাকে মাথার দিকে গোলাকার করে মাটির নীচে ফুট তিনেক গর্ত করে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে পোঁতা বা গাড়া হয়। কোথাও কোথায়ও পাশাপাশি দুটো একটি ছোট গর্ত আর একটি চওড়া গর্ত করা হয়। তারপর চওড়া গর্ত থেকে শক্ত কাঠের খিল ঠুকে ঠুকে মাটির নীচ দিয়ে ছোট গর্তে দিয়ে দেওয়া হয় আর এই ছোট গর্তেই কাঠের খিলের সঙ্গে বাঁধা হয় পাটের বিনুনি করা সেই মোটা দড়ি এবং গর্তগুলো খুব ভালো করে বোঝানো হয়।
এরপর জায়গাটি গোবর জল দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। এরপর গ্রামের যুবকরা আর ক্ষেত মজুররা শাল বল্লি বা শক্ত বাঁশের সাহায্যে সেই পাটের বিনুনী কে মাটির তলা থেকে তোলেন। যে বা যাঁরা পৈড়ান তোলেন তাঁদের জন্য থাকে পুরস্কার। যার বেশিরভাগটা খাদ্যদ্রব্য। শোনা যায় কোন কোন সম্পন্ন কৃষক পুরস্কার হিসাবে ছাগল বেঁধে রাখেন।
আবার বিনুনী ছিঁড়ে গেলে যিনি পুঁতেছেন তাঁকে "ফাইন" হিসাবেও খাওয়াতে হয় পৈড়ান তোলার দলকে। পাটের পরিবর্তে কোথায়ও কোথাও বাঁশের কঞ্চি বা বনের শক্ত লতাকেও ব্যবহার করা হয়।
দিন বদলেছে, বদলেছে উৎসবের ধরণ ও জৌলুস। এখনও কোথাও কোথাও গ্রামের মোড়ে ছেলে ছোকরারা নিজ উদ্যোগে "পৈড়ান" গড়েন এবং তোলেন। এখনও জঙ্গলমহলের সুবর্ণরেখা অববাহিকার ঝাড়গ্রামের জুনশোলা গ্রাম সহ বেশ কিছু গ্রামে পৈড়ান হয়। এবারেও বিশ্বজিৎ পাল, সুব্রত পাল, সোমনাথ সেনাপতি, রিপন মান্না, সুমন পাল, সঞ্জয় দন্ডপাট, অমল পালের মতো কিছু উৎসাহী যুবকের উদ্যোগে জুনশোলা গ্রামে পৈড়ান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কারও কারও মতে পৈড়ান আসলে দৈত্যরাজ বলি পূজার অঙ্গ। পুরাণ মতে বিষ্ণুভক্ত দৈত্য প্রহ্লাদের পৌত্র ছিলেন বলি রাজ। তিনি বিষ্ণু বিদ্বেষী ছিলেন। যজ্ঞবলে তিনি পরাক্রমশালী হন। বামন অবতারের ছদ্মবেশে বিষ্ণু তাঁর কাছে তিন পাদ ভূমি চেয়ে পাতাল প্রবেশে বাধ্য করান। পরে বলি বিষ্ণুর আশীর্বাদ পান। বলা হয়ে থাকে কার্তিক মাসের অমাবস্যার প্রতিপদে দৈত্যরাজ বলিকে স্মরণ করলে পূণ্য হয়। তাই অনেকে মনে করেন পৈড়ান তোলার মধ্য দিয়ে দৈত রাজ বলির চুলের মুঠি তুলে পাতাল থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।
এ বিষয়ে গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে এই কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এই উৎসব গুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। কালের প্রবাহে অনেক লোক উৎসব জঙ্গলমহল থেকে হারিয়ে গিয়েছে। পৈড়ান এখনও ধারাবাহিক। তাদের দাবি এই উৎসবই একদিন দেখবে গোটা জগৎবাসী।