নিজস্ব সংবাদদাতা: নমিতা রায় মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি তার পুত্র 'সুনামি'-এর জন্ম দেন। কি নাম থেকে কিছু মনে পড়ছে? ২০০৪ সালের সেই বিধ্বংসী দিন। বড়দিনের আনন্দ সবে কেটেছে কি কাটেনি, আচমকায় সবটা লণ্ডভণ্ড করে দেয় প্রবল ভূমিকম্প। আর তার জেরে তৈরি হওয়া সুনামি।
এই নমিতা রায় সাপে ভরা গভীর জঙ্গলে সেই সময় তাঁর ছেলের জন্ম দেন। তার পরিবারের সাথে কাটান বেশ কিছু দিন। তাই আজ ২০ বছর পরও সেই স্মৃতি তরতাজা।
এই প্রসঙ্গে নমিতা রায় জানিয়েছেন, “আমি সেই অন্ধকার দিনটির কথা মনে করতে চাই না। আমি গর্ভবতী ছিলাম এবং প্রতিদিনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ, আমি একটি ভয়ঙ্কর নীরবতা লক্ষ্য করলাম এবং সমুদ্রকে আমাদের তীর থেকে মাইল দূরে সরে যেতে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। পাখিদের মধ্যেও হাহাকার দেখেছিলাম সেই সময়। আর তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই, ভয়ানক জোরালো শব্দে সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়তে থাকে বিশাল প্রাচীর হুট বে দ্বীপের দিকে। তারপরেই শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়। আমি দেখি লোকেরা চিৎকার করে পাহাড়ের দিকে ছুটছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে জ্ঞান হারায়”।
নমিতা দেবীর কথায়, “ঘণ্টা খানেক পরে, আমি জ্ঞান ফিরে পায়। পাহাড়ী জঙ্গলের গভীরে হাজার হাজার স্থানীয়দের মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়। আমি আমার স্বামী এবং আমার বড় ছেলেকে দেখে স্বস্তি পায়। আমাদের দ্বীপের বেশিরভাগ অংশই তখন ভয়ঙ্কর ঢেউ গ্রাস করেছে"।
কোভিড-১৯ মহামারীতে স্বামী লক্ষ্মীনারায়ণ মারা যাওয়ার পর তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় তার দুই ছেলে সৌরভ এবং সুনামির সাথে বসবাস করছেন।
আর সেখান থেকেই ওই দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। তাঁর কথায়, "রাত ১১.৪৯-এ আমার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। কিন্তু সেই সময় আশেপাশে কোন ডাক্তার ছিল না। আমার স্বামী সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনো চিকিৎসা সহায়তা পেতে পারেননি। তারপর তিনি কিছু মহিলার কাছে আবেদন করেন যারা আমাকে সাহায্য করে। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে সুনামির জন্ম হয়"।
জন্মের পর শুরু হয় আরও এক যুদ্ধ। বেঁচে থাকার যুদ্ধ, সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। নমিতা রায়ের কথায়, "কোনো খাবার ছিল না এবং সমুদ্রের ভয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার সাহসও আমার ছিল না। এরই মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আমার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। কোনোরকমে, আমি আমার নবজাতক শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে খাওয়াই। পরিবর্তীতে আমাকে আরও চিকিৎসার জন্য পোর্ট ব্লেয়ারের জিবি প্যান্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল"।
হাট বে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ১১৭ কিমি দূরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। আর এই ভাবেই শেষ হয় তাদের সেই সময়কার জীবন যুদ্ধ। ২০ বছর পরও এই স্মৃতিতে কেঁপে ওঠেন নমিতা রায়। তবে 'সুনামি' দেখেই মনে বল পান!