কালাপানির কারবাস, জেনে নিন সেলুলার জেলের বন্দিদের অজানা কথা

ব্রিটিশ আমলের সবচেয়ে ভয়ানক কারাগার।

author-image
Adrita
New Update
ওঃ

ফাইল ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ভারতের স্বাধীনতার জন্য বহু বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা প্রাণ দিয়েছেন। ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে বিগত ২০০ বছর ধরে।

Andaman & Nicobar Islands | Cellular Jail was a place of exclusion and  isolation dgtl - Anandabazar

ভারতীয়দের ওপরে অত্যাচার চালানোর জন্য ব্রিটিশরা চরমসীমা পার করে গিয়েছিল। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অধিকাংশ বন্দিরা আত্মঘাতী হয়েছিল বলেও জানা গিয়েছে। আরও জানা গিয়েছে যে, অনেক সময়েই প্রাণদণ্ড বা অন্য কারণে মৃত বন্দিদের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হত সাগরের জলে। 

সাগরের জল কালো হোক না হোক, নৃশংস অত্যাচারের ক্ষত কালোর থেকেও গভীর। স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু আগে থেকেই আন্দামান ছিল ব্রিটিশদের তৈরি ‘কালাপানি’। সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকেই এখানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হত বন্দিদের। অত্যাচারী ব্রিচিশ শাসক সেই ধারা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ক্ষেত্রেও।

ইংরেজরা বিপ্লবীদের আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি বানিয়ে রেখেছিল। শুধু বন্দিই নয়, তাদের ওপরে অকথ্য শারীরিক অত্যাচার চালানো হত। বন্দিদের পায়ে শিকল বেধে রাখা হত। এছাড়াও, গায়ে সিগারেটের ছ্যাকাও দেওয়া হত। চাবুকের ঘা মারা হত তাদের। অত্যাচারের পরে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেত।

Andaman & Nicobar Islands | Cellular Jail was a place of exclusion and  isolation dgtl - Anandabazar

ইতিহাস বলে যে, এই জেলের বন্দিদের জন্য বরাদ্দ খাবারের মানও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এমনকি অসুস্থ হলে পর্যাপ্ত ওষুধপত্রেরও ব্যবস্থা ছিল না। এর প্রতিবাদে বন্দিরা জেলের মধ্যেই অনশনে বসেন। 

সিপাহি বিদ্রোহের পরে প্রায় দুশো জন বিদ্রোহীকে আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছিল ব্রিটিশরা। মুঘল রাজবং‌শের অনেক সদস্য এবং সিপাহি বিদ্রোহের সময় যাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরের পাশে ছিলেন, তাঁদের অনেকেরই নিয়তি ছিল কালাপানি।

এই সেলুলার জেলেই বন্দি ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, ফজল-ই-হক খয়রাবাদী , যোগেন্দ্র শুক্লাবটুকেশ্বর দত্ত , বিনায়ক সাভারকরবাবারাও সাভারকরশচীন্দ্রনাথ সান্যাল,  ইন্দুভূষণ রায়, উল্লাসকর দত্ত, হরেকৃষ্ণ কোনারভাই পরমানন্দসোহান সিংসুবোধ রায়, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, বারিন্দ্র কুমার ঘোষ, শের আলি আফ্রিদিসহ অন্যান্যরা। 

উনিশ শতকের শেষে পরাধীন ভারতে তুঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফাঁসির পাশাপাশি সশস্ত্র পথের বিপ্লবীদের বেশিরভাগেরই শাস্তি হয়েছিল দ্বীপান্তর। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার বুঝল, এ বার আন্দামানে দরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা সমেত একটি কারাগার।

এছাড়াও, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় এই জেলে বন্দি ছিলেন মহাবীর সিং, ভগত সিং। আর্মস অ্যাক্ট মামলায় দোষী সাব্যস্ত মোহন কিশোর নমাদাস, মোহিত মৈত্র। বলপূর্বক খাবার খাওয়ানোর কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল।  

মূলত ব্রিটিশ রাজকর্মচারী চার্লস জেমস ল্যাল এবং চিকিৎসক এ এস লেথব্রিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল সেলুলার জেল। ১৮৯৬ সালে শুরু কারাগার নির্মাণের কাজ। শেষ হয় ১৯০৬ সালে। তৎকালীন বর্মা থেকে ঘন লাল রঙের ইট এনে প্রথমে তৈরি হয়েছিল কারাগার।

সেলুলার জেলের সেলগুলি ছিল একে অন্যের থেকে একদমই বিচ্ছিন্ন। জানা যায় যে, সেলগুলি এমন ভাবে বানানো হয়েছিল, যাতে কোনও বন্দি অন্য কারও মুখ দেখতে না পারেন। ফলে তাদের মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় ছিল না। এ ভাবেই ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এর ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এক কথায় বলতে হয় যে, কালাপানির এই জেলটিতে ছিল ব্রিটিশ সরকারের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। 

কারাগার ভবনের সাতটি শাখা ছিল। কেন্দ্রে ছিল টাওয়ার। যেখান থেকে রক্ষীরা নজরদারি চালাতেন। বাইসাইকেলের চাকায় যেমন স্পোক থাকে, সে ভাবে কেন্দ্র থেকে বিস্তৃত ছিল শাখাগুলো।

কারাগারের গঠনটি ছিল তারকা চিহ্নের মত। কারাগার ভবনের সাতটি শাখা ছিল। কেন্দ্রে ছিল টাওয়ার। যেখান থেকে রক্ষীরা নজরদারি চালাতেন। বাইসাইকেলের চাকায় যেমন স্পোক থাকে, সে ভাবে কেন্দ্র থেকে বিস্তৃত ছিল শাখাগুলো। কারাগারে মোট ৬৯৬টি সেল ছিল। ১৪.৮ x ৮.৯ ফিটের প্রকোষ্ঠগুলিতে থাকত একটি মাত্র ঘুলঘুলি। সেটাও মেঝে থেকে ৯.৮ ফিট উচ্চতায়। 

‘সেলুলার জেল’ নাম এসেছে ‘সেল’ বা প্রকোষ্ঠ থেকে। কারাগারে মোট ৬৯৬টি সেল ছিল। ১৪.৮ x ৮.৯ ফিটের প্রকোষ্ঠগুলিতে থাকত একটি মাত্র ঘুলঘুলি। সেটাও মেঝে থেকে ৯.৮ ফিট উচ্চতায়।

ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন যে, এই জেলে অন্তত ৮০ হাজার জন বিপ্লবী বন্দি ছিলেন। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে, ছেঁড়া ফতুয়া গলায় পেঁচিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন বিপ্লবী ইন্দুভূষণ রায়। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ১৪ বছর বন্দিজীবন কাটিয়েছেন সেলুলার জেলে। অত্যাচরে জর্জরিত বিপ্লবী আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। শেষে তার জায়গা হয়েছিল কারাগারের লুনাটিক ওয়ার্ডে। অবশেষে ১৯২০ সালে মুক্তি লাভের পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। 

প্রকোষ্ঠগুলি এমন ভাবে বানানো হয়েছিল, যাতে কোনও বন্দি অন্য কারও মুখ দেখতে না পারেন। ফলে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় ছিল না। এ ভাবেই ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এর ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সরকার।