নিজস্ব প্রতিবেদন : পুজো শুরু হতে এখনও ২ সপ্তাহ বাকি, কিন্তু মণ্ডপগুলো এখন চূড়ান্ত ব্যস্ততায় গিজগিজ করছে। এর মধ্যেই বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মল্লরাজ পরিবারের মহা ধুমধামে শুরু হলো দেবী মৃন্ময়ীর পুজো। ১০২৮ বছরের ঐতিহ্য মেনে স্নান পর্ব শেষে সাত সকালেই রাজ মন্দিরে এলেন বড় ঠাকুরানি। স্থানীয় মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু কামানের শব্দ বাজিয়ে দেবীর আগমনবার্তা জানান দিল। এই পুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও প্রতীক। মল্লরাজ পরিবারের এই রীতি মেনে চলার মাধ্যমে প্রতিটি বছর উজ্জীবিত হয় স্থানীয় মানুষের উৎসাহ।
প্রাচীন মল্ল রাজত্বের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে দেবী মৃন্ময়ীর ইতিহাস। ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দের আগে মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুর এলাকায়। সে বছর রাজা জগৎমল্ল শিকারের উদ্দেশ্যে জঙ্গলে প্রবেশ করে পথ হারান। ক্লান্ত হয়ে একটি বট গাছের তলায় বসে পড়েন, সেখানেই অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হন। দেবী মৃন্ময়ীর আদেশে ওই গাছের নিচে একটি মন্দির নির্মাণের নির্দেশ পান। রাজা মল্ল সেখানে দেবীর সুবিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঘন জঙ্গল কেটে রাজধানী সরিয়ে আনেন বিষ্ণুপুরে। এরপর থেকে দীর্ঘ ১০২৮ বছর ধরে এই পুজো বহু উত্থান পতনের সাক্ষী। এককালে এখানে বলিদান প্রথা ছিল, কিন্তু পরে মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হলে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। তারা শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করে তোপধ্বনীর প্রচলন করেন, যা আজও চলে আসছে। আজকের পুজোয় প্রতিটি নির্ঘণ্ট ঘোষণা করা হয় তোপধ্বনীর মাধ্যমে, যা ঐতিহ্যের এক অনন্য চিহ্ন।
সারা রাজ্যে দুর্গাপুজা কালিকা পুরাণ অনুযায়ী হলেও বিষ্ণুপুরের রাজপরিবারের মৃন্ময়ী পুজো হয় একটি প্রাচীন বিশেষ পুঁথি, বলিনারায়নী, অনুসারে। এই পুজো শুরু হয় জীতাষ্টমীর পরের দিন, নবমী তিথিতে। এবছরও তার অন্যথা হয়নি। আজ নবম্যাদি কল্পারম্ভে সাত সকালে দেবীর আগমন ঘটল প্রাচীন মন্দিরে। সুপ্রাচীন রীতি অনুযায়ী রাজ দরবারের গোপালসায়েরে স্নানপর্ব সেরে মন্দিরে আনা হল বড় ঠাকুরণী, মহাকালীকে। দেবীপক্ষের চতুর্থী তিথিতে মেজ ঠাকুরণী, মহালক্ষ্মী, এবং সপ্তমীর দিন ছোট ঠাকুরণী, মহা সরস্বতী, আনা হবে। এই তিন ঠাকুরণী স্থানীয় ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বিশেষ পট।
সময়ের সঙ্গে মল্ল রাজারা রাজ্যপাট হারালেও, মৃন্ময়ীর আগমনে আজও মল্লভূমে পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় দূরদূরান্তের প্রজারা তোপের শব্দ শুনে আগমনের খবর জানত। যদিও আজ সেই তোপের আকার ছোট হয়েছে, এখনও তা দাগা হয় স্থানীয় মুর্ছা পাহাড় থেকে। পুজোর বোধনের ১৫ দিন আগে থেকেই প্রাচীন মল্লভূমের মানুষ উৎসবে মেতেওঠেন।