নিজস্ব প্রতিনিধি, মেদিনীপুর: তুলসী চারার মেলা, পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুরের সীমানা লাগোয়া অঞ্চলে হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে এ এক ব্যস্ততার সময়। হরেক রকম পণ্যের হরেক রকম দোকান। সবং ও পটাশপুরের মানুষের হৃদয়ের মিলনের মেলা এই মেলা। চলুন ৫০০ বছরের পুরোনো এই মেলা ঘুরে দেখা যাক। কিভাবে যাবেন, কি কি দেখবেন বিস্তারিত জানতে পারবেন।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় গ্রামীন মেলা হল এই তুলসী চারার মেলা। প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন ও একেবারে ভিন্ন ধরনের এই মেলা। একপারে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, ওপর পারে পূর্বের পটাশপুর। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কেলেঘাই নদী। পটাশপুর ও সবং এলাকার ২-৩টি মৌজা নিয়ে (গোকুলপুর, খাউখান্ডা, কোলন্দা) প্রায় ১৩-১৪ একর জায়গা জুড়ে এই মেলা বসে। পটাশপুরের গোকুলপুর গ্রামে নদী পাড়ে আছে সেই তুলসী মঞ্চ, যাকে কেন্দ্র করে এই মেলা। সেটির উচ্চতা এখন একটি দোতলা বাড়ির সমান।
মূলতঃ নানা ধরনের তুলো এবং বৈষ্ণবদের খোল যা মৃদঙ্গ নামেই পরিচিত তা কেনাবেচার জন্য মেলাটি বিখ্যাত। বর্তমান দিনে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠের সমস্ত উপকরণই পাওয়া যায়। সবং-পটাশপুরের মাদুর, অমর্ষি ও বাগমারির শঙ্খ, মাটির হাঁড়ি-কলসি, স্টীল-অ্যালুমিনিয়াম-পিতল-কাঁসার বাসনপত্র, লোহার সামগ্রী, টাটকা শাক-সবজী ও ফল, কাঁচা মাছ-মাংস-ডিম, তেলেভাজা-পাঁপড় ভাজা-জিলিপি-গজা-মুগের জিলিপি-মিষ্টি, ভাতের হোটেল, চা-কফির দোকান, পেটাই পরোটা-কচুরি-ঘুগনী-মুড়ি-ডিম টোস্ট-চিকেন কারি, ডাব, রঙীন সরবৎ, হজমী গুলি, জামা কাপড়, চশমা, লেপ-কম্বল-শাল-শোয়েটার, গামছা-মশারী, জুতো, সেলুন দোকান, কসমেটিকস্, আয়ূর্বেদিক ঔষধ, ডাক্তারখানা, মুদি দোকান, হস্তরেখা বিচার, ঘাট-আলমারি-শোকেস-চেয়ার টেবিল-ট্রাঙ্ক, ঘর সাজানোর উপকরণ, সোনা-রুপার গহণা, টিয়া-মুনিয়া পাখি ও গিনপিগ-খরগোশ (বেআইনি ভাবে বিক্রি হয়), নানা ধরনের চারাগাছ, সাইকেল দোকান ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাছাড়া নাগরদোলা, মরণ কূপ, ডিস্কো ড্যান্স, ম্যাজিক শো, মিনি সিনেমা শো ইত্যাদির মতো আধুনিক বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে।
অষ্টাদশ শতকের বাকসিদ্ধ বৈষ্ণব সাধক শ্যামানন্দী বৈষ্ণব চূড়ামণি শ্রী গোকুলানন্দ বাবাজী পটাশপুর, সবং ও আশে পাশের বিশাল এলাকায় বৈষ্ণবাচার্যরূপে বন্দিত ছিলেন। কথিত আছে, পৌষ সংক্রান্তির মধ্যরাতে কেলেঘাই নদীর মাঝে নিজের যোগ মঞ্চে তিনি স্বজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন। দেহত্যাগ করার আগে গোকুলানন্দজী তাঁর প্রিয় শিষ্য বিপ্রপ্রসাদ ভূঞ্যাকে (গ্রামের জমিদার পরমানন্দ ভূঞ্যার ছেলে) তাঁর যোগ মঞ্চেই সমাহিত করার আদেশ দিয়ে যান। তিনি বলেছিলেন, পৌষ সংক্রান্তির মধ্য রাত্রির পর যে ভক্ত নদীতে স্নান সেরে তাঁর যোগমঞ্চের তুলসী গাছের গোড়ায় নদীর তিনমুঠো মাটি দেবে, তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।
সেই থেকে পৌষ সংক্রান্তির দিন তাঁর সমাধি ভূমিতে (গোকুলপুর) তুলসী চারার মেলা বসে। সেখানে হাজার হাজার নরনারী শীতের ভোর রাত থেকে কেলেঘাই নদীতে ডুব দিয়ে মাটি তুলে তুলসীমঞ্চে দিয়ে পুজো নিবেদন করে। মাটি জমতে জমতে যায়গাটা একটা ছোট টিলার আকার ধারন করেছে। নদীর ঘোলা জলে ডুব দিয়ে ভেজা কাপড়ে মাটি দিতে দিতে পথটি ভীষণ ভাবে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। তখন প্রায় দোতলার সমান উঁচু সমাধির শিখরে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রীতিমতো হড়কাতে হড়কাতে, আছাড় খেতে খেতে পুণ্যার্থীরা সমাধি চূড়ায় উঠে মাটি দেবার প্রচেষ্টা সত্যিই দেখার মতো বিষয়। কম বয়সী ছেলেপুলের দল চূড়ায় পৌঁছাতে পারলেও বয়স্করা পারেন না। তারা সমাধির (টিলার) গোড়ায় মাটি দেন।
স্থাণীয় বাসিন্দাদের মতে, তখনকার দিনে সমাধিভূমি সংলগ্ন এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। হায়না, বাঘ, সাপ, ভীমরুল ইত্যাদির প্রচুর উপদ্রব ছিল। জন্ত জানোয়ারের ভয় উপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তির দিন মানুষ দলে দলে ভীড় করত। জনবসতি গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এখন আর সেসবের ভয় নেই।
খড়গপুর/মেদিনীপুর/বালিচকগামী লোকাল ট্রেনে বালিচক স্টেশনে নেমে, পটাশপুরগামী বাসে দেহাটি ব্রীজে নেমে টোটোতে মেলা প্রাঙ্গণ। বালিচক স্টেশন থেকে (৩৬ কিমি) গাড়ি ভাড়াও পাওয়া যায়। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ৬নং জাতীয় সড়কে ডেবরা হয়ে বালিচক-তেমাথানি-দেহাটি ব্রীজ হয়ে তুলসীচারার মেলা যেতে পারেন। গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে।