নিজস্ব প্রতিনিধি, পশ্চিম মেদিনীপুর : গণেশ এবং বিশ্বকর্মা পুজোর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে উৎসবের মরশুম। সামনেই দুর্গাপুজো। পুরো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং নভেম্বরও রয়েছে পুজোর বাজার।আর এই পুজো এলেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় সেই পূর্বপুরুষ ধরে চলে আসা ঢাকের আওয়াজের। আর এই ঢাক বাজিয়ে জঙ্গলমহল অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের খেতুয়া ঢাকিপাড়া সেজে ওঠে প্রতিবছর। শুধু জেলার না, জেলা বাদে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য, দেশে ঢাক বাজাতে তারা বায়না ধরে। আর এই পুজোর কটা দিনে যখন সবাই উৎসবে মেতে ওঠে তখন পরিবার-পরিজন ছেড়ে ঢাক বাজাতে দূরে পাড়ি দেন ঢাকিরা। এরকমই এক ঢাকি গ্রামের নাম খেতুয়া।
প্রসঙ্গত, এখানে প্রায় ২৭টি পরিবার থাকে যারা বাবা কাকা,জ্যাঠা সহ পূর্ব-পুরুষদের হাত ধরে এই ঢাক বাজিয়ে আসছে। এক সময় যখন ঢাকই ছিল প্রধান বাদ্যযন্ত্র।সেই সময় ঢাক বাজিয়ে আর সেই টাকা রোজগার করে সংসার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত পরিবার গুলি। মূলত সমাজ থেকে পিছিয়ে পড়া এই পরিবারের মূল আয়ের উৎসই ঢাক বাজানো। সেই সময় ঢাকের চাহিদাও ছিল সর্বত্র। পুজো পার্বণ সহ বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়তা ছিল ঢাক। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকের জায়গায় দখল নিয়েছে বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, বাদ্যযন্ত্র সহ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট।এখন আর ওই কষ্ট সহযোগে ঘন্টার পর ঘন্টা রাত জেগে ঢাক বাজাতে হয় না। হাত ব্যথা হয় না একটানা কাঠি দিয়ে ঢাক বাজাতে গিয়ে ঢাকিদের। কারণ মিউজিক সিস্টেমের ঢাকের আওয়াজ চালিয়ে দিলেই ২৪ ঘন্টা ধরেই চলতে থাকে সেই ঢাকের আওয়াজ আর তাতেই পুজো সারছে বর্তমান প্রজন্ম। এই মাইকে ঢাকের আওয়াজের পাশাপাশি এখন বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট ও বাজারে ব্যবহৃত হচ্ছে আর তাতে প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে ঢাকিদের। যারা সারা বছর ধরে অপেক্ষা করত এই পুজোর কটা মাস মোটা টাকা উপার্জন করে গোটা বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করবে, তারা এখন পড়েছেন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
খেতুয়া গ্রামের এরকমই এক ঢাকি গ্রামের পুজোর সময় যারা বিভিন্ন জায়গায় ঢাক বাজাতে যান তাদের সমস্যার কথা শুনিয়েছেন । মূলত এবারে পুজো কমিটি গুলো অতি অল্প টাকায় তাদের বুক করছে। যেখানে পুজো মণ্ডপ প্রতিমা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা খরচা করেছে সেখানে তাদের বায়না করেছে সামান্য টাকায়। কারণ হিসেবে দেখিয়েছে অপ্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে। আর সেই সামান্য টাকা বায়না নিয়েও ইতিমধ্যেই ঢাকিরা পাড়ি দিতে শুরু করেছে রাজ্য জেলা সব ভিন্ন রাজ্যে। উদ্দেশ্য একটাই পরিবারের জন্য সারা বছরের সঞ্চিত ঘরে আনা। যদিও এই ঢাকি এই ঢাক বাজিয়ে কতদিন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন তা প্রশ্ন রয়ে গেছে তাদের মধ্যেই। এছাড়াও শিল্পীরা আক্ষেপ জানিয়েছেন অন্যান্য শিল্পীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে ও তাদের ভাগ্যে জুটে নি সামান্য সরকারি সহযোগিতা টুকু।
এই বিষয়ে ঢাকি শুভাশিস রুইদাস বলেন, ''প্রতিদিন যেভাবে ইন্সট্রুমেন্ট এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বেরোচ্ছে তাতে ঢাকিদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে অনেক দিন আগেই।যতটুকু প্রয়োজন রয়েছে তা মানুষ অতি অল্প টাকায় বায়না করছে। আর তাতেই আমাদের জীবিকা জীবন নির্ধারণের সমস্যা বাড়ছে।আমরা না পেয়েছি কোন সরকারি সাহায্য, না কোনো সুবিধা।তবুও আমরা পূর্বপুরুষ ধরে চলে আসা ঢাক এখনোও বাজিয়ে চলছি।'' অন্যদিকে সুদর্শন রুইদাস ও জয়দেব রুইদাসরা বলেন, ''এক সময় ছিল যখন বাবা কাকা জ্যাঠাদের হাত ধরে এই ঢাক বাজানোর তালিম নেওয়া। আমাদের গ্রাম ঢাকি গ্রাম নামে পরিচিত।আমরা অবসর সময়ে চাষবাস করে থাকি। আগের মত বর্তমানে ঢাক বাজানোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। যতটুকু প্রয়োজন রয়েছে মানুষের তা অল্প টাকার। তাই আমরা এক প্রান্তেই রয়ে গিয়েছি। যেহেতু অন্য কাজ আমরা শিখিনি, তাই এই পেশা আমরা পরিবর্তন করতে পারিনি। আমাদের আশা হয়তো একদিন আবার এই ইন্সট্রুমেন্ট মিউজিক প্লেয়ার ছেড়ে আমাদের পুরনো সেই নস্টালজিয়ার ঢাক বাজানো আবার ফিরে আসবে।''