নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ফুটবল খেলতে বড্ড ভালোবাসত। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলত। আইআইটি কী? সেখানে কী পড়ানো হয় মাধ্যমিক পর্যন্ত এসব কিছুই ধারনাই ছিলনা তাঁর। বাবা পোল্ট্রি ফার্মে লেবারের কাজ করেন। মা গৃহবধূ।
মাঝে মধ্যে, চাষের কাজে দিন মজুরি করতে যান। স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই তেমন ভাবে লেখাপড়া জানেন না। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া। কিন্তু ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর খুব ইচ্ছে। স্কুলের শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য, নজরদারিতে এবং নিজের অদম্য ইচ্ছের জোরে দিন মজুরের ছেলে জঙ্গলমহলের অভিজিৎ মাঝি আইআইটি-তে ভর্তি হয়ে তাক লাগালেন।
অভিজিতের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের গুড়গুড়িপাল থানার কঙ্কাবতী গ্রামে। বাবা-সুকুমার মাঝি পোল্ট্রি ফার্মের লেবার। মা-কাঞ্চনী মাঝি গৃহবধূ। অভিজিতরা তিন ভাই। বড়দাদা বিশ্বজিত উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পলিটেকনিক ডিপ্লোমা মাঝ পথে ছেড়ে ভারতীয় ডাক বিভাগে চাকরি পেয়েছেন। মেজদাদা শুভজিত মেদিনীপুর আইটিআই’তে কারিগরি বিদ্যা নিয়ে পরাশোনা করছেন। আর অভিজিৎ ২০২৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সুযোগ পেয়েছেন আইআইটি’তে। গত মঙ্গলবার ওড়িশার ভুবনেশ্বর আইআইটি-তে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছেন।
জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালে জঙ্গলমহলের অভিজিৎকে দশগ্রাম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুগল প্রধানের নজরে আনেন এক ফুটবল কোচ। সুব্রত কাপ খেলতে যায় দশগ্রাম হাই স্কুলে। ছোট থেকেই অভিজিৎ ভালো ফুটবল খেলে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে মাঝ পথে কঙ্কাবতী স্কুল থেকে গিয়ে ভর্তি হয় সবংয়ের দশগ্রাম সতীশচন্দ্র সর্বার্থসাধক শিক্ষাসদন স্কুলে।
তারপর থেকে খেলাধূলা, পড়াশুনো চলে ওই স্কুলেই। ২০২১ সালে মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ (৬৬৪) নম্বর পায়। দারিদ্রতার কারনে স্কুলের হস্টেলে থাকা, খাওয়া, স্কুলে পড়াশুনোর খরচে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করেদেন প্রধান শিক্ষক যুগল প্রধান। অভিজিৎ উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা ওখানেই। ৪৫১ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এবার। ইচ্ছে ছিল ভালো কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতায় চেষ্টাও চালিয়ে যায় অভিজিৎ। অবশেষে আইআইটি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়ে আইআইটি ভুবনেশ্বরে ভর্তির সুযোগও পেয়ে যান।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুগল প্রধান বলেন, “২০১৯ সালে আমাদের স্কুল সুব্রত কাপ খেলতে যাওয়ার আগে অভিজিৎ অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়। ভালো ফুটবল খেলে। ছেলেটি পরাশুনোতেও ভালো। পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত হোস্টেল, স্কুলের খরচ আমরাই ব্যবস্থা করে দিই। মাধ্যমিকে সেবার স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরও পায়। একাদশ শ্রেণি থেকে আমাদের স্কুলের ‘কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ ওর পড়াশনায় নানা রকমভাবে সাহায্য করে। স্কুল এবং ট্রাস্টের সভাপতি প্রাক্তন শিক্ষক দীপক পট্টনায়ক এসব বিষয়ে খুবই হেল্পফুল। মাঝে মধ্যে নিজে বায়োলজি পড়িয়েছেন। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক রণজিৎ বাবু, গণিতের শিক্ষক মলয় বাবু পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করেছেন। আমাদের স্কুলের প্রাক্তনী ট্রাস্টের সদস্য ডক্টর নিরঞ্জন শীট অর্থ দিয়ে, অনলাইনে পড়াশোনার জন্য ট্যাব কিনে দিয়ে অভিজিতের লেখাপড়ায় সাহায্য করেছেন। এভাবে অনেকেই অভিজিতের মতো দুঃস্থ পড়ুয়াদের আমাদের ট্রাস্টের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অভিজিৎ আইআইটি ভুবনেশ্বরে ভর্তি হয়েছে। আমরা ওর সাফল্য কামনা করি। ও আরও এগিয়ে যাক।”
অভিজিতের মা কাঞ্চনী মাঝি বলেন, “আমরা নিজেরা লেখাপড়া জানিনা। তাই ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলাম। আমার তিন ছেলেরই পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে। ওর বাবা একটি পল্ট্রি ফার্মে কাজ করে। আমিও লোকের জমিতে চাষের কাজ করতে যায়। ওর বাবা আর পারছিল না। অভাবের সংসারে বড় ছেলে মাঝ পথে পড়া ছেড়ে ডাক বিভাগে কাজে ঢুকে গেল। ছোট ছেলে খুব ফুটবল খেলত। ওর খেলা দেখেই দশগ্রাম স্কুলের শিক্ষকরা অভিজিৎকে তাঁদের স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে লেখা পড়া শেখালেন। উনাদের মতো লোকজন না থাকলে আজ আমার ছেলে ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারত না।”
ভুবনেশ্বর থেকে অভিজিৎ বলেন, “স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুগলবাবু, কাজলবাবু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভাপতি দীপকবাবু, স্কুলের প্রাক্তনী নিরঞ্জনবাবু এবং স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য ছাড়া আমি এই জায়গায় আসতে পারতাম না। আমি যদি কোনওদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, তাহলে ওই স্কুলের জন্য, কাজল্বাবু মেলোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। যাতে আরও অনেক দুঃস্থ ছেলেরা পড়ার সুযোগ পায়।”