জুয়েল রাজ: বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে কাঙ্খিত, মানুষের সবচেয়ে ভালোবাসার বিষয় হচ্ছে ভোট। এই ভোট বিষয়টা মানুষের মাথায় এমন ভাবে চাষাবাদ করা হয়েছে, আমাদের চালিত করা ভেড়া পালের রাখালরা বিষয়টি এমনভাবে মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ভোট দেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কোনও কাজ নেই। আপনি শুধু ভোট দেবেন, বাকি চেটেপুটে খাবার কাজটা ওঁরা করে দেবেন।
রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, সরকার বলতেই বোঝায় ভোট। এই নির্বাচন বি্ষয়টা আমাদের জিনে মিশে গেছে। ক্লাবে নির্বাচন, পাড়ায় নির্বাচন, শিক্ষকদের নির্বাচন, ডাক্তারদের নির্বাচন, বাজার কমিটির নির্বাচন, স্কুল কমিটির নির্বাচন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন, ব্যবসায় নির্বাচন- এমন কোনও বিষয় বাংলাদেশে নেই যেখানে নির্বাচন নেই।আমি নিজেও দুইবার সাংবাদিকদের একটি সংগঠনে নির্বাচন করেছি এবং দুইবারই পরাজিত হয়েছি এবং বুঝেছি নির্বাচন আমার কর্ম নহে৷ বিগত এক মাসে ঢাকা শহরে শুধুমাত্র ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ মারা গেছে এই হিসাবটা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নেই। বিশ্ব মহামারি করোনা যা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে, সেই করোনায় সারা দেশ মিলেও এই পরিমাণ মানুষ মৃত্যু বরণ করেনি যে পরিমাণ মানুষে মৃত্যু বরণ করছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ জাতির বিবেক বলে মাথায় তুলে নাচি তাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাদের কাছেও বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা হচ্ছে ভোট এবং নির্বাচন। কোন রাজনৈতিক দলকে ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। একদিকে বিদেশী শক্তি, অন্যদিকে নিজের চারপাশের নিজের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছু নিয়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি নবাব সিরাজুদ্দৌলা যখন দিশেহারা তখন প্রেমিকা আলেয়ার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন- বাংলার আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা, কে দেবে আশা কে দেবে ভরসা? প্রায় তিনশত বছর পরে সেই একই অবস্থা যেন ফিরে এসেছে।
বর্তমান সময়ে এসে মানুষের দিন শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমের শুভ সকাল দিয়ে। গণ মাধ্যমের চেয়েও দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছে এখন সামাজিক মাধ্যম। মানুষ এখন তথ্যসূত্র হিসাবে বিভিন্ন ফেসবুক অথবা অনলাইন টিভির নাম ব্যবহার করে। নিত্য নতুন তারকাদের আমরা পেয়েছি। তাই প্রতিদিনই সেখানে কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকে। চলতি সপ্তাহের আলোচিত বিষয় মিশন সিঙ্গাপুর। বিএনপির নীতি নির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের একযোগে স্বপরিবারে সিঙ্গাপুর সফর নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা রকম বক্তব্য পালটা বক্তব্য চালাচালি হলেও এবারের মিশন সিঙ্গাপুর বিষয়টি হালকা ভাবে দেখার সুযোগ নেই।
বিএনপি রাজনৈতিকভাবে হালে জল পায়নি। দিকভ্রান্ত নাবিকের মত অকূল সাগরে ভেসে চলছে। কপালকুন্ডলার মত বলা যায়, ''পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ"। তাই আন্দোলন সংগ্রাম, জনগণের অধিকারের চেয়ে তাদের কাছে জরুরী হয়ে পড়েছে ক্ষমতায় যাওয়া, শেখ হাসিনা সরকারের পতন। কিন্তু বিএনপি কি চাইলেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারবে? এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরেই আসে। রাজনীতিতে পথ হারালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রযুক্তিকে খুব দারুনভাবে পেশাদারীত্বের সাথে কাজে লাগিয়েছে সংগঠনটি। বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যদি কেউ চোখ রাখেন তবেই বুঝতে পারবেন। মনে হবে বাংলাদেশে আসলে বিএনপি বা তার সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষও নেই এবং যারা সেখানে বিভিন্ন মন্তব্য করেন তাদের মন্তব্যের ধরণ ও ভাষা প্রায়ই একই।
দলটির নেতাদের সিঙ্গাপুর সফরের সাথে সাথেই একটি বক্তব্য খুব প্রচারিত হচ্ছে, "পরিবর্তন আসন্ন"। আসলেই কি পরিবর্তন আসন্ন? বিএনপি কি সরকার গঠনে প্রস্তুত? এক কথায় উত্তর দিলে, না। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। বিএনপি নিজেরাও চায় না তারা এই মুহূর্তে সরকার গঠন করুক। তৃণমূলের নেতা কর্মীদের সাথে আলোচনা করলেই সেটি জানা যায়, বোঝা যায়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি সরকার গঠন করলে ৬ মাসও সেই সরকার টিকতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত নেতৃত্বের এই দূরাবস্থা নেতাদের আস্থার অভাব, অবিশ্বাস সবকিছু মিলিয়ে, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক যে মেগা প্রকল্প দেশে চলছে বিএনপি তা সামলাতে পারবে না। আর রাজনৈতিক দল হিসাবে সরকারের চেয়ে বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ ভয়ংকর পরিমানে শক্তিশালী হয়ে ওঠে যা বিএনপি সামলাতে পারার মত ক্ষমতায় নেই। আবার অনেকেরই ধারণা বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে দেশে অরাজক অবস্থা শুরু হবে, আইন-শৃঙ্খলা বিএনপি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ২০০১ সালের চেয়েও ভয়ানক অবস্থা হবে বাংলাদেশে, গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হবে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি ক্ষমতায় না আসা দেশের জন্য, বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক।
তাহলে বিকল্প কী? বিএনপির এই আন্দোলন, সংগ্রামের রহস্য কী? বিএনপি কি আদৌ নির্বাচন চায় কিংবা ক্ষমতায় যেতে চায়? কারণ আইনীভাবে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সেই ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে? দেশে ফিরলেও তারেক রহমান আইনীভাবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
বিএনপির একমাত্র দাবি তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্ত আওয়ামী লীগ সরকার কোনওভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তাই বিএনপি বিকল্প রাস্তায়, বিকল্প ভাবনায় পথ হাঁটছে। বিএনপি মনে প্রাণে চাইছে একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হোক যার মাধ্যমে তারা তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে চায়। আইনীভাবে যাতে তারেক রহমান বাংলাদেশে নির্বাচন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সেটিই তাদের মূল চাওয়া। বিএনপির ভেতরে অবিশ্বাস এত প্রকট যে সিদ্ধান্ত নিতে নেতাদের সিঙ্গাপুর বৈঠকে বসতে হচ্ছে। বিএনপি চেয়ে আছে বিদেশের দিকে, নানা রকম মহাসমাবেশ, পদযাত্রা দিয়ে তারা বিদেশী শক্তিকে তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে চাইছে যে দেশের মানুষ তাদের সাথে আছে।
একটি তুর্কি লোককাহিনী, নানা দেশে নানাভাবে পঠিত হয়। গল্পটি এই রকম, বনের রাজা সিংহ শিয়ালকে ডেকে বলে - যা আমার জন্য খাবার নিয়ে আয়। শিয়াল
ঘোড়ার কাছে গিয়ে বলে- ভাইজান কেমন আছেন? ঘোড়া চিন্তা করে- যে শিয়াল খ্যাঁক খ্যাঁক করা ছাড়া কোনও কথা বলে না সে আজ এতো মধুর স্বরে ডাকছে কেন? নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে। ঘোড়া শিয়ালের ডাকে সাড়া দেয় না। শিয়াল এবার ময়ুরীর কাছে গিয়ে বলে- কেমন আছো? দেখতে খুবই মিষ্টি লাগছে। ময়ুরীও বুঝতে পারে- শিয়ালের মুখে মিষ্টি বচন। নিশ্চয়ই লক্ষণ ভালো না। সেও সাড়া দেয় না। শিয়াল এবার গাধার কাছে গিয়ে বলে- বাহ! তোমাকে খুবই হ্যান্ডসাম মনে হচ্ছে। এরকম হ্যান্ডসাম একটা প্রাণী খেটে খেটে জীবনটা নষ্ট করে দিলো। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। রাজার বয়স হয়ে গেছে। তিনি অবসরে যাবেন। আর তোমাকে রাজা বানাবেন। চলো আমার সাথে সিংহাসনে চলো। গাধা খুব খুশি হয়। শিয়ালের সাথে সিংহাসনে আসে। সিংহের কাছে আসা মাত্রই সিংহের এক থাবায় গাধা তার কান দুটো হারায়। কিন্তু কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচে। শিয়াল গাধার কাছে এসে বলে- এতো বোকা হলে রাজা হবে কিভাবে? রাজা তোমার মাথায় মুকুট পরাবে। কিন্তু দুপাশে দুটো কান থাকলে কি রাজমুকুট ঠিকমতো মাথায় বসবে। তাই তো তোমার কান দুটো তুলে নেওয়া হয়েছে। চলো চলো আমার সাথে চলো। দেরি হলে অন্য কেউ আবার রাজা হয়ে যাবে। গাধা আবার সিংহের কাছে আসে। এবার সিংহের আরেক থাবায় তার লেজখানা খসে পড়ে। কিন্তু এবারও পালিয়ে বাঁচে। শিয়াল যথারীতি গাধার কাছে এসে বলে- আবারও ভুল করলে। লেজ থাকলে রাজ সিংহাসনে বসবে কিভাবে। তাই তোমার লেজটা খসানো হয়েছে। চলো চলো তাড়াতাড়ি সিংহাসনে চলো। গাধা আবারও সিংহাসনে আসে। এবার আর সে বাঁচতে পারে না। সিংহের থাবায় তার ক্ষত বিক্ষত দেহখানা মাটিতে পড়ে আছে। সিংহের দাঁতে-মুখে রক্তের দাগ। শিয়াল সিংহকে বলে - মহারাজ এতো কষ্ট করে আপনি খাবেন? মাথাটা আমাকে দেন। সুন্দর করে প্লেটে সাজিয়ে দেই। শিয়াল গাধার ব্রেনটুকু খেয়ে মাথার অবশিষ্ট অংশ সিংহকে দেয়। সিংহ বলে- ব্রেন কোথায়? শিয়াল বলে- মহারাজ যে বারবার ধোঁকা খেয়েও আপনার কাছে এসেছে, আপনি কি মনে করেন তার ব্রেন বলে কিছু আছে? গাছের ডালের উপর থেকে ময়ুর বলে- তার ব্রেন ঠিকই আছে। কিন্তু অতি সহজ সরল হওয়ায় প্রতারকদের বুঝতে পারেনি। প্যাঁচা তার সন্তানকে বলে -এই ঘটনা থেকে তোমরা কী শিখলে? হঠাৎ করে কেউ যদি বড় আপন হয়ে ওঠে, বুঝতে হবে তার গোপন দূরভিসন্ধি আছে। এটাও শিখলাম- যার যে কাজ তাকে সেটাই করতে হয়। অন্যের কুমন্ত্রণা শুনতে হয় না। লোভের ফল কখনও মিষ্টি হয় না।
সাদাসিধা হওয়া ভালো। কিন্তু বোকা হওয়া ভালো না। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা শিখলাম তা হলো- প্রতারকদের একবার বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু বারবার বিশ্বাস করা যায় না। অতি বিশ্বাস করে সে ঠকেছে। আর নিজের জীবন দিয়ে তার বিশ্বাসের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ঠিকই গাধার সিংহাসন লাভের মতোই। লেজ-কান সবই গেছে, এখন শুধু প্রাণটা যেতে বাকী। আমেরিকা যখন হঠাৎ করে বাংলাদেশের এত ভাল মন্দ খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে আমাদের এত আপন হয়ে উঠেছে, বুঝতে হবে সেখানে তাদের দূরভিসন্ধি আছে। আর সেই দুরভিসন্ধির সাথে আঁতাত করতেই বিএনপির এই মিশন সিঙ্গাপুর।