নিজস্ব সংবাদদাতা, পাণ্ডবেশ্বর: অতি প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের সভ্যতা, শিল্পকলা, সাহিত্যের পাশাপাশি স্থাপত্যতেও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল প্রাচীন ভারত। প্রাচীন মন্দির ও সাহিত্য থেকে তার অনেক নিদর্শন আমরা পেয়ে থাকি। ভারতে দ্বাপর ও ত্রেতাযুগের কিছু শিব মন্দির এখনও রয়েছে, যার অধিকাংশই পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাণ্ডবরা তাদের ১২ বছরের নির্বাসনে অনেক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাণ্ডবেশ্বরে এসে পঞ্চপাণ্ডব ও মাতা কুন্তীর ছ’টি শিবলিঙ্গ স্থাপনও তেমনই এক ‘সত্যি’। কবে, কখন এই লোকশ্রুতি চলতে শুরু করেছিল, আজ আর তার হদিস মেলে না। কিন্তু পাণ্ডবেশ্বর সংলগ্ন এলাকার নামকরণ দেখে প্রায় সকলেই মনে করেন পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় এইখানে ছিলেন। যেমন পাণ্ডবেশ্বর এলাকার পাশেই রয়েছে বীরভূম জেলার ভীমগড়া, পাঁচড়া, কৃষ্ণপুর, রাজনগর বক্রেশ্বর। আবার অজয় নদীর এপারে রয়েছে কেন্দ্রা শ্যামল্যা ছত্রিশ ঘন্টা ইত্যাদি স্থান। এমনই দুটি স্থান পাণ্ডবেশ্বরের পঞ্চপান্ডব মন্দির ও ভুঁড়ি ফরফরি এলাকার উত্তরেশ্বর শিব মন্দির যা স্থানীয়রা মনে করেন যে এই সবই পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাসের সময়কার।
পঞ্চপান্ডব মন্দিরের পুরোহিত অজিত তিওয়ারি, ভুড়ি গ্রামের বিমান রায় ও জগৎপতি রায় জানান যে তারা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শুনে এসেছেন যে পঞ্চপান্ডবরা পাণ্ডবৎসরে এসে এক বছর অজ্ঞাতবাসে ছিলেন, সেই সময় সুরঙ্গ পথে পঞ্চপান্ডব এসে সিংহবাহিনী ঘাটে উঠতেন এবং সেখানে উত্তরেশ্বর শিব মন্দিরে পুজো দিতেন। পুজো দেওয়ার সময় পাশের সতী বাঁধ থেকে পদ্মফুল তুলে নিয়ে আসতেন তারা আবার সেই সুরঙ্গ পথেই পাণ্ডবৎসর ফিরে যেতেন বর্তমানে সিংহবাহিনী ঘাট এর অবশিষ্টাংশ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। একদা এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন বিরাট সেই বিরাট রাজার পুত্র ছিলেন উত্তর। সেই উত্তরের নাম অনুযায়ী এই মন্দিরের নাম হয়েছে উত্তরেশ্বর শিব মন্দির। এই শিব মন্দিরে পুজোর সময় অলৌকিকভাবে কদমগাছে মাত্র দুটি ফুল ফোটে সেই ফুল দিয়েই উত্তরেশ্বর শিব মন্দিরের পুজো হয়। এই উত্তরেশ্বর শিব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত অমিও অধিকারী জানান বংশ পরম্পরায় কয়েক শতক ধরে তাদের পরিবার এই মন্দিরে পুজো করে আসছেন তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছেন যে একদা পঞ্চপান্ডব এই শিবমন্দিরে পূজা করতেন তিনি আরো জানান মন্দির থেকে ১০০ মিটার দূরে একটি কদম গাছ রয়ে এই গাছে সারাবছর এই কোন ফল ফুল হয় না। কিন্তু পুজোর দিন সকাল থেকে ভক্তরা সেই গাছের নিচে পূজা আরচনা করেন সন্ধ্যার পর থেকে কয়েক দফায় আবার এই কদম গাছটিকে ঘিরে পূজা রচনা চলে সকালে সূর্য উদয়ের সঙ্গে এই কদম গাছটিতে মাত্র দুটি ফুল পাওয়া যায় সেই ফুল দিয়েই এই মন্দিরের পূজো হয় তিনি জানান পৌরা পৌরাণিক কার্ডের অনেক নিদর্শন এখনো রয়েছে এই মন্দিরটিকে ঘিরে যদি সরকার সঠিকভাবে এই এলাকার দিকে নজর দেন তাহলে এই এলাকাটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।
পাণ্ডবেশ্বর পঞ্চপান্ডব মন্দিরের পুরোহিত অজিত তিওয়ারি জানান জনশ্রুতি যে অজ্ঞাতবাসের সময়ে মাতা কুন্তীকে নিয়ে এক সময়ে অজয় নদের ধারে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাঁচ ভাই। পাশাপাশি একটি করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতেন তাঁরা। অজয়ের পাশে তা-ই এখন পাণ্ডব মুনির আশ্রম হিসেবে পরিচিত। শিব মন্দিরের পিছনের এই কাহিনির জন্যই এলাকা পাণ্ডবেশ্বর হিসেবে খ্যাত বলে জানান তিনি। আরও কথিত রয়েছে, অজয়ের ও পারে প্রতি সপ্তাহে এক রাক্ষস আসত। প্রতি পরিবারকে পালা করে এক সদস্যকে তার হাতে তুলে দিতে হত আহার হিসেবে। কুন্তীর নির্দেশ মতো ও পারে গিয়ে সেই রাক্ষসকে বধ করেন ভীম। সেই থেকে সেই এলাকা ভীমগড়া বলে পরিচিত। তা এখন বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত।
তবে কবে থেকে এই সব জনশ্রুতি শুরু হয়, এলাকার প্রবীণেরাও সে নিয়ে ধন্দে। এটুকু শোনা যায়, অষ্টাদশ শতকে ঘনশ্যাম নামে এক সাধক এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। সেই থেকেই শিব মন্দিরগুলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাস যাই থাকুক পশ্চিম বর্ধমান জেলা সহ অন্যান্য জেলার মানুষ যে শিবর শিবরাত্রি সময় উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
জামুরিয়ার বিরকুল্টি গ্রামের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বরাজ দত্ত জানান তিনিও তার পূর্বপুরুষদের কাছে পঞ্চপান্ডবের গল্প শুনেছেন। কিন্তু পুরাণ বলছে, এ বঙ্গ ‘পাণ্ডববর্জিত’। অর্থাৎ, এখানে কখনও পাণ্ডবদের পা পড়েনি। তবে সেটা ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন। কিন্তু এলাকার মানুষ বিশ্বাস করেন যে এ এলাকায় পঞ্চপান্ডবরা এসেছিলেন।