নিজস্ব সংবাদদাতা: দিনটা ছিল সেই ২২ জুলাই। মাত্র একদিন আগেই কেটেছে ২১ জুলাইয়ের বড় সমাগম। সবে একটু নেতা-মন্ত্রীরা জিরিয়ে নিচ্ছেন, এমন সময় সাইক্লোনের মত হাজির এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। আর মুহুর্তে পালটে গেল রাজ্যের হালহকিকত। গোটা দেশ তো বটেই, বিশ্বেরও বেশ কিছু দেশ জেনে গেল পশ্চিমবঙ্গের আরও একটি নতুন পরিচয়। কিনা, শিক্ষা দুর্নীতিতে গ্রেফতার খোদ শিক্ষামন্ত্রী!
সেই সময় প্রাক্তন হলেও দুর্নীতির শুরুয়াৎ যে সময় থেকে, সেই সময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন তিনিই। ঠিক এক বছর আগে এই আজকের দিনেই রাজ্যের শাসক দলের তৎকালীন মহাসচিব তথা রাজ্যের তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। আর গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে।
তখনও অবশ্য কেউ জানতেন না এই গল্পের পরতে পরতে রয়েছে রোমাঞ্চ। যেকোনও ক্রাইম থ্রিলারকে হার মানাবে এই ‘অপা’ কাণ্ড। ও এখানে বলে রাখা ভালো, একজন তো হলেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর আরেকজন হলেন তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ বান্ধবী’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। আর তাদের নাম ভেঙেই ‘অপা’।
সেই অর্পিতার বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয়েছিল টাকার পাহাড়। পাওয়া গিয়েছিল – শিক্ষা দফতরের নাম ছাপানো খাম, উচ্চ শিক্ষা দফতর সংক্রান্ত সরকারি নথি, স্কুল শিক্ষা দফতরের ডায়েরি এবং আরও অনেক কিছু।
নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় যা তথ্য প্রয়োজন ছিল তা সবই পেয়েছিল ইডি আধিকারিকরা। কিন্তু এর সাথে উপরি পাওনা ছিল টাকার পাহাড়। এক বছর আগে টাকার পাহাড় দেখে নড়েচড়ে বসেছিল গোটা বাংলা। চক্ষু ছানাবড়া হয়েছিল বাঙালির! এক বঙ্গললনার দু’টি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছিল নগদে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
টাকা পাওয়ার আনুমানিক হিসাবটা ছিল এরকম – গত বছরের ২২ জুলাই টালিগঞ্জের ‘ডায়মন্ড সিটি’ আবাসনে অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে নগদ ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা উদ্ধার করে ইডি। একই সঙ্গে উদ্ধার হয় প্রচুর বিদেশি মুদ্রা এবং সোনার গয়নাও।
এরপরে ২৭ জুলাই বেলঘড়িয়ার ‘ক্লাব টাউন হাইটস্’ আবাসনে অর্পিতার নামে থাকা দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে মোট ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা নগদ উদ্ধার করে ইডি। সঙ্গে পাওয়া যায় প্রচুর গয়না।
আলাদিনের আর্শ্চয্য প্রদীপের কথা মনে পড়ে কি? ঘরের একটি আলমারি, ডিভানের তলা থেকে ভর্তি ভর্তি টাকা উদ্ধার করে ইডি কর্তারা। টাকা গুনতে আনা হয় প্রায় ৫-৬টি RBI এর টাকা গোনার মেশিন। যে দৃশ্য বেশ কিছু প্রজন্ম মনে রাখবে অনায়াসেই।
ইডির দাবি, অর্পিতার দু’টি ফ্ল্যাট মিলিয়ে মোট ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং ৫ কোটি ৮ লক্ষ টাকার গয়না উদ্ধার হয়েছিল। বর্তমানে তা অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ভ্লটে রাখা রয়েছে যত্ন সহকারে।
বর্তমানে এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে ইডি-সিবিআই-এর কাছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের আগে থেকে শুরু করে তাঁর গ্রেফতারের পর পর্যন্ত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই ধরা পড়েছেন ইডির জালে। মামলার জল গড়িয়েছে বহু দূর। জামিন পাওয়ার সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু এখনও তাঁর বর্তমান ঠিকানা প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার। আর অর্পিতার ঠিকানা মহিলা সংশোধনাগার। এই একবছরে অবশ্য তাদের প্রেমপর্বের সাক্ষী থেকেছে কোর্ট চত্বর। কিন্তু তাতেও শুনানি শেষে যে যার নিজের পথে।
এই রকম ভাবেই ‘অপা’ কাটিয়ে ফেললেন এক বছর। পার্থ চট্টোপাধ্যায় জামিন পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। তাই বদলেছেন নিজের আইনজীবীও। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এতো সহজে কি নিস্তার মিলবে? কবে ফিরতে পারবেন নিজের ‘বিজয়কেতন’এ? আর জামিন যদি পেয়েও যান, তার পরবর্তী জীবন কেমন হবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের?
এই একটি বছর শেষ হল এরকমই হাজারও প্রশ্নের ভিড় নিয়ে।