অনিতা ঘোষ বোস, থাইল্যান্ডঃ থাইল্যান্ড যার প্রাচীন নাম ছিল 'সিয়াম' বা 'শ্যামদেশ'। ভ্রমণপিয়াসী অগণিত ভারতীয় নাগরিক আসেন এই সুন্দর দেশটি ভ্রমণ করতে। এখানে প্রায় দু'লক্ষাধিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ আছেন। কয়েক হাজার মানুষ আছেন যারা কর্মসূত্রে এখানে এসেছেন। ভারতের অতি নিকট এই প্রতিবেশী দেশটি সম্বন্ধে তবুও বোধ হয় আমাদের জানার গণ্ডিটা বেশ খানিকটা সীমাবদ্ধ।
প্রচলিত চিন্তাভাবনা ও আধুনিক যুগের প্রচার মাধ্যম এবং তথাকথিত কিছু জীবনচর্চার সৌজন্যে সত্যিই থাইল্যান্ড সম্পর্কে মানুষের মনের পটভূমিতে অনেক ভুল ধারণা আছে। শুধুমাত্র ট্যুরিস্ট স্পট বা উপভোগ্য স্থান হিসাবেই তার অধিক পরিচিতি। কিন্তু শুধু কি তাই? কলকাতা থেকে মাত্র দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিট দূরত্বের এই সুন্দর দেশটির প্রকৃত রূপ কী ইতিহাস কী, কোন ঐতিহ্যের অনুসারী, কোন সামাজিক আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে এখনও এদেশের সাধারণ মানুষ জীবন নির্বাহ করে—তার কিছুটা ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রতিবেশী একটি দেশ, যেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়, সেই দেশকে একটু অন্যরকমভাবে দেখার চেষ্টা করি।
বিগত আট নয় বছর ধরে এই দেশটির সঙ্গে পরিচিত, 'ব্যাঙ্কক ন্যাশনাল মিউজিয়াম এর প্রথম ভারতীয় গাইড হওয়ার সৌজন্যে এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকায় এই দেখার পথটা উন্মুক্ত হয়েছে। ফলে এক সাংস্কৃতিক মনন সমৃদ্ধ থাইল্যান্ডকে জানার প্রয়াস আরও গভীরতা পেয়েছে। এই প্রয়াসের অভিজ্ঞতা অনেক কিছু শিখিয়েছে, জানিয়েছে আরও জানার প্রবণতাকে, মনের মধ্যে জাগরিত করেছে সাউথ ইস্ট এশিয়া সম্পর্কে। রাজ ইতিহাস সম্বলিত এবং বৌদ্ধধর্মের অনুসারী একটি দেশ; এর অন্তরে ফল্গু নদীর মতো হিন্দুধর্মের প্রবাহ কিভাবে বর্তমান তারই কিছু কথা নিয়ে এসেছি আজ।
বর্তমান রাজবংশের নাম 'চক্রী রাজবংশ'। গড়ুর থাইল্যান্ডের সরকারি চিহ্ন, যেহেতু ভগবান বিষ্ণু এই দেশে ভীষণ সম্মানিত। এখনও শতকরা ৯৫ জন মানুষ যে দেশে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, সেই দেশে হিন্দু দেবদেবীর কি ভূমিকা এবং আচরণীয় ও পালনীয় অনুষ্ঠানে তাদের কিরূপ প্রভাব তার সামান্য কিছু, উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর— সনাতন ভারতের এই ত্রিমূর্তির বন্দনা এদেশে বিশেষ রূপে হয়। সঙ্গে দেবী-অৰ্চনাও আছে। উমা, পার্বতী, লক্ষ্মী, সরস্বতীর আরাধনাতেও পিছিয়ে নেই "শ্যামদেশ"। দেবরাজ ইন্দ্র এবং তাঁর বাহন ঐরাবতেরও বিশেষ ভূমিকা এখানে বর্তমান। এবং সর্বোপরি দেবতা গণেশের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
বিঘ্নহর্তা গণেশকে দিয়েই শুরু করা যাক। থাই ভাষায় যে কোনও দেবতাকে বোঝাতে 'ফ্রা' (Phra) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গণেশকে থাইভাষীরা ভালবেসে বলেন 'ফ্রা ফি কা নেত' (Phra Phi Ka Net)। 'ফা' মানে দেবতা, ফি মানে বড় ভাই। সুতরাং একটি দেশ যখন গণেশকে ভালবেসে বড় ভাই বলে, অনুমেয় কতটা শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে। এখানকার অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লোগো ব্যবহৃত হয় তা গণেশের মূর্তি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম ভলেন্টিয়ারের লোগোও এটি। ব্যাংকক ন্যাশনাল মিউজিয়াম এর এশিয়ান আর্ট বিভাগের বিশাল গণেশ মূর্তিটি অসম্ভব সুন্দর এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও সেটি অতিমান্য প্রায় দশম শতাব্দীর মূর্তি। এছাড়াও আরও অনেক গণেশ মূর্তি আছে নানা আকারের। ব্যাংকক-র লিটল ইন্ডিয়াতে আগামীকাল গণেশ চতুর্থীর জন্য যা আয়োজন হয়েছে তা দেখে কুমার টুলির কথাটি মনে পড়ে যায়।
বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ গণেশ মন্দির ব্যাংকক থেকে কয়েক কিমি দূরে অবস্থিত। পিঙ্ক গণেশ (Pink Ganesh) নামে এটি পরিচিত। বিভিন্ন আকৃতির গণেশ মূর্তি দেখা যায় বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের খননকার্যের ফলে আমাদের এই হিন্দু দেবতা আবিষ্কৃত হয়েছেন। এখানে গণেশের বাহনেরও কদর খুব।