দুর্গাপুজো ও বিজয়া দশমীর নানা কথা, জানুন গল্প

দুর্গাপুজো ও বিজয়া দশমীর নানা মাহাত্ম্য তুলে ধরলেন লবণহ্রদ বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক।

author-image
Aniket
New Update
grw

সজলকান্তি মণ্ডল, প্রধানশিক্ষক, লবণহ্রদ বিদ্যাপীঠ, কোলকাতা ৬৪:

 বাংলা তথা ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসবের কথা বললে বিজয়া দশমীর কথা সর্বাগ্রে মনে আসে। আক্ষরিক অর্থে বিজয়া একটি COMPOSIT FESTIVAL. এই উৎসবে সুন্দরভাবে আধ্যাত্মিক, জাতীয় ,সামাজিক ও লৌকিক ভাবাবেগ সম্পৃক্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিজয়া উৎসবকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিজয়া ও দুর্গোৎসবকে  পৃথকভাবে দেখা যাবে না ।আমরা আমাদের পৌরাণিক হিন্দু শাস্ত্র থেকে দুটি স্থানে দুর্গাপূজার বর্ণনা পাই ।

প্রথমটি শ্রী শ্রী চন্ডী বা মার্কন্ডেয় পুরান এবং দ্বিতীয়টি রামায়ণ। তবে দুর্গাপূজা পদ্ধতি মূলত গৃহীত হয়েছে কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ এবং দেবীপুরান থেকে। শ্রী শ্রী চন্ডীতে আমরা দেখি রাজ্য ও পরিবার-পরিজন চ্যুত হয়ে রাজা সুরথ এবং শ্রেষ্ঠী সমাধি বনবাসী হয়ে মেধা মুনির কাছে ক্রমান্বয়ে দেবী কর্তৃক মধুকৈটভ বধ, মহীষাসুর বধ, চন্ডমুন্ড বধ , রক্তবীজ বধ ও নিশুম্ভ-শুম্ভ বধের কাহিনী শুনে দেবীর কৃপা লাভের জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠলেন। বন ও নদী তীর থেকে লব্ধ দ্রব্যাদিতে দুর্গাপূজা করলেন। সম্ভবত সেখান থেকেই নবপত্রিকা দুর্গার অবতারনা। কলা -রম্ভাণী/ কচু -কালি /হলুদ -দুর্গা /জয়ন্তী -কার্তিকী/ বিল্ব-শিবা /দারিম্ব- রক্ত দন্তিকা/ অশোক-শোক রহিতা/ মান- চামুন্ডা এবং ধান মহালক্ষী অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পূজিতা। কৃত্তিবাস ওঝার বাংলার রামায়ণেও আমরা দেখতে পাই বনবাসী শ্রী রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দুর্গাপূজায় ব্রতী হয়েছেন। সহজেই অনুমান করা যায়, শ্রীরামচন্দ্রও হয়তো রাজা সুরথ ও শ্রেষ্ঠী সমাধির পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যদিও অনেক পন্ডিতের মতে সুরথ ও সমাধি কোন ঋতুতে দুর্গাপূজা করেছিলেন তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে একথা সর্বজন বিদিত যে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে অকালবোধন করেছিলেন এবং দেবীর কৃপা লাভ করে বিজয়া দশমীতে রাবণ বধ করেছিলেন। যদিও বাল্মিকীর মূল রামায়ণে দুর্গাপূজা তত সবিস্তারে বর্ণিত নয়। হয়তো এমন হতে পারে বাংলায় যেহেতু দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল তাই কবি কৃত্তিবাস সুকৌশলে এই পর্বকে বাংলার রামায়ণের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। আমরা যদি বাংলায় প্রচলিত দুর্গোৎসবের ইতিহাস খুঁজতে যাই তাহলে দেখব প্রায় কৃত্তিবাসের সমসাময়িক পন্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য মহাশয় দুর্গোৎসব তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। তিনি বহু হিন্দু শাস্ত্র মন্থন করে এই তত্ত্ব প্রতিস্থাপন করেন। তার বর্ণনায় প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গাপূজার কৃত্য কর্ম অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রতি পদে কেশ সজ্জা, দ্বিতীয়াতে বস্ত্র, তৃতীয়াতে দর্পণ সিন্দুর ও অলক্ত, চতুর্থীতে মধুপর্ক, পঞ্চমীতে অস্ত্র ও অঙ্গরাগ, ষষ্ঠীতে বোধন, সপ্তমীতে মহাস্নান ,অষ্টমীতে মহা পূজা, নবমীতে বলি এবং দশমীতে হোম ও আহুতি। যদিও বর্তমানে এত বিস্তৃত আচার অনেকটাই সংক্ষিপ্ত হয়েছে। সেটাও কিন্তু রঘুনন্দনের বিধান মেনেই। তিনি সপ্তমীতে স্নান অষ্টমীতে পূজা নবমীতে বলি এবং দশমীতে হোম এর বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিন আহুতি প্রদানের দ্বারা বিজয় বা কৃপা লাভ। যদিও কালক্রমে দুর্গা পূজার হোম দশমীর পরিবর্তে নবমীতে সাধিত হয়। এই বর্তমান পদ্ধতিতে দুর্গাপূজার প্রচলনের প্রথম হদিস পাওয়া যায়, দিনাজপুরের জমিদার কর্তৃক। পরবর্তীকালে তাহেরপুরের জমিদার রাজা কংস নারায়ণ ও নদীয়ার রাজা ভবানন্দ দুর্গাপূজা আরম্ভ করেন। এই সময়কাল থেকে বিজয়া উৎসবের সঙ্গে সামাজিক সম্মেলন সংযুক্ত হতে থাকে। পরবর্তীকালে গুপ্তিপাড়া ও বাগবাজারে এই দুর্গোৎসব সর্ব্বজনীন ও বরোয়ারী রূপ পায়। ঐতিহাসিক বহু ঘটনায় প্রমানিত দুর্গোৎসবের মধ্যে বিজয়া সম্মেলনকে সংযুক্ত করে মুঘল আমলে এই আনন্দযজ্ঞে অহিন্দুদেরকে শামিল করার কৌশল নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে দেশীয় রাজা তথা জমিদাররা ইংরেজ সাহেবদেরকে তুষ্ট করার জন্য দুর্গোৎসবের অঙ্গ হিসাবে  বিজয়া সম্মেলনে সাহেবদেরকে আমন্ত্রণ করতে থাকেন এবং সেখানে থাকতো খানাপিনা ও উপঢৌকনের এলাহি ব্যবস্থা। অন্যদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবীরা এই বিজয় ক্ষনকে অস্ত্র পূজার মাধ্যমে শক্তি লাভ করার এবং দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের অঙ্গীকার করার মুহূর্ত হিসাবে পালন করতেন। বহু জায়গায় তার প্রমাণ আছে। আবার শুধুমাত্র হিন্দু নয় রাঢ় বাংলার আদিবাসী সম্প্রদায় এই দিনে পুরুষরা নারী সেজে  ভূয়াং নৃত্যে মেতে ওঠেন। হয়তো তাঁদের আরাধ্যা হুদুড়  দুর্গার আরাধনা করেন। এমনকি বর্তমান কর্পোরেট দুনিয়াতেও দুর্গোৎসব তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

শুভ বিজয়া দশমী : সময় এল বিদায়ের, জেনে নিন বিজয়া দশমীর তাৎপর্য |  Vijayadashami 2022 : History, Importance And Significance - Bengali BoldSky



বিজয়া উৎসবকে আমরা ত্রিমাত্রিক বলতে পারি।

    প্রথম মাত্রাটি হল আধ্যাত্মিক। বিজয়ার দিন যখন দর্পণ নিরঞ্জন করা হয় তখন বলা হয়,

ওঁ উত্তরে শিখরে দেবি ভুমাং পর্ব্বত বাসিনি।

  ব্রহ্মযোনি সমুৎপন্নে গচ্ছ দেবী মমান্তরম্।

   অর্থাৎ এই তিথিতে দেবী আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে আসছেন। বাইরের মন্ডপ পরিত্যাগ করে ব্রহ্মস্বরূপ মানব অন্তরে আসীন হচ্ছেন। প্রতিটি মানুষ এই তিথিতে দেবময় রূপে প্রকাশ পাচ্ছেন।  চিরন্তন বৈদিক মহাবাক্যকে প্রতিমা পূজার ফল হিসাবে গ্রহন করা হচ্ছে। সুন্দর ভাবে ভক্তি ও জ্ঞানের বা সকার ও নিরাকারের সমন্বয়। এই আত্মপ্রকাশকে আহ্বান জানানোর জন্য প্রত্যেকে প্রত্যেককে আমরা কোলাকুলি করি। প্রতিমাতে  যে শক্তির আহ্বান করা হয়েছিল অন্তরে তার প্রতিষ্ঠান হল। আমরা নির্ভয় হলাম কেননা আমার অন্তরে দেবী দুর্গা সদা বিরাজমানা হলেন। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে এই দুর্গাপূজার MOTIVATIONAL EFFECT।

দ্বিতীয় মাত্রা হলো সামাজিক ও লৌকিক। যেকোনো আধ্যাত্মিক কর্ম যদি সামাজিক জীবনে না আসে তাহলে তা আচারই থেকে যায়, উৎসবে পরিণত হতে পারে না। আমরা দেখি বিজয়া তিথির সঙ্গে অনেক সামাজিক রীতি এমনকি অবশ্য পালনীয় বেশ কিছু কর্ম বহু এলাকায় ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পালিত হয়। যেমন, কৃষক পরিবারে বিজয়া দশমীতে রান্নার প্রচলন। যাঁরা ব্যবসা করেন তাঁরা এই দিনটিকে পূন্যতিথি হিসাবে মানেন। এছাড়াও বিজয়ার আড্ডা, সম্মেলন এবং একত্রে ভোজন তা আজ সত্যই ব্যাপকতা লাভ করেছে যা আমাদের সমাজ জীবনকে সমৃদ্ধ করছে।

তৃতীয় মাত্রা ব্যাক্তিত্ব বিকাশ। শুধু সমাজ জীবন নয় ব্যক্তিত্বের উন্নয়নেও এই উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক LEADERSHIP DEVELOPMENT এর ধারণায় CONFLICT MANAGEMENT একটি বড় বিষয়। প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের চলার পথে CONFLICT বা মতের অমিল আমাদের চিরসঙ্গী। কিন্তু অনেক সময় তা নিরসনের সুযোগের প্রয়োজন হয়। প্রবাহমান বিজয়া সম্মেলনের রীতি আমাদের এই সুযোগ করে দেয়। যাদের সঙ্গে হয়তো কোন কারণে সামান্য বিবাদ-বিসংবাদ বছরের কোনও সময় হয়েছে, তা মিটিয়ে নেবার সুযোগ করে দেয় বিজয়া সন্মেলন।

শুধু তাই নয় আমাদের জীবনে দুঃখ বিষাদ এরা থাকবেই কিন্তু তাকে জীবনের অঙ্গ হিসাবে দেখতে প্রনোদিত করে দুর্গাপূজা। অস্বীকার না করে জীবন যাপনের পথ দেখাবার সুন্দর আয়োজন এই দুর্গোৎসব তথা বিজয়া সম্মেলন। আসুন এই শুভ মুহূর্তে আমাদের আকুতি হোক স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়

কালি তুই প্রলয় ও রূপিনী

আয় মাগো আয় মোর পাশে ।

সাহসে যে দুঃখদৈন্য চায়

মৃত্যু যে বাঁধে বাহু পাশে ।

কালনৃত্য করে উপভোগ

মৃত্যুরূপা তারই কাছে আসে।

শুভ বিজয়া দশমী আজ – Malay News Bengali- Popular All Bangla Newspapers

 

hiring.jpg

 

hiring 2.jpeg