চার হাত বিশিষ্ট অভয়া! কে হেঁটে বেড়ায় রাতের অন্ধকারে?

হরিপাল থানার নালীকুল বড়গাছিতে ২৯৩ বছরের প্রাচীন সিংহ, বসু মল্লিক ও রায় পরিবারের পুজো নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ব্যস্ততা। রাতের অন্ধকারে এই বাড়ির জাগ্রত দেবী এখনো হেঁটে বেড়ায়।

author-image
Debapriya Sarkar
New Update

নিজস্ব প্রতিবেদন : চার হাত বিশিষ্ট অভয়া মূর্তি এখনও খুব জাগ্রত, এবং ষষ্ঠীর অধিবাসের পর ঠাকুর দালানে মাকে একা রাখা যায় না। পরিবারের দুজন সদস্য প্রতি রাতেই মায়ের সঙ্গে থাকেন। রাতের গা ছমছমে পরিবেশে তারা অনুভব করেন, যেন নুপূর পায়ে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। ২৯৩ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়ির এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে একাধিক অলৌকিক ঘটনা।

publive-image

শারদ উৎসব শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। অতিবৃষ্টির পর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে, আর জলাশয়ের পাশে কাশফুল দুলছে। সর্বত্র উৎসবের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। বারোয়াড়ির পাশাপাশি বাড়ির পুজোরও শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা চলছে। হরিপাল থানার নালীকুল বড়গাছিতে ২৯৩ বছরের প্রাচীন সিংহ, বসু মল্লিক ও রায় পরিবারের পুজো নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। পুজোর আয়োজন যেন কোনও খামতি না থাকে, সেই জন্য ঠাকুর দালানে বৈঠক চলছে। এখনও প্রাচীন রীতিনীতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে দেবীর আরাধনা করেন এই তিনটি পরিবার।

publive-image

সিংহ, বসু মল্লিক ও রায় পরিবারে মা অভয়া রূপে পুজিত হন। চার হাত বিশিষ্ট দেবীর গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চন। মায়ের বাঁ দিকে উপরের হাতে চক্র, নিচের হাতে সাপ, ডান দিকে উপরের হাতে খরগোশ এবং নিচের হাতে ত্রিশূল থাকে। দেবীর আরাধনা গুপ্ত পঞ্চিকার মতে হয়। পাঁচ খিলান যুক্ত ঠাকুর দালানে মন্দিরের মাথায় ত্রিমুখী তিনটি ত্রিশূল এবং মাঝে চক্র রয়েছে। বছরের পর বছর একই কাঠামোতে তৈরি হয় প্রতিমা। দশমীতে বিসর্জনের পর মাটি কিছুটা ধোয়ার পর কাঠামোটি তোলা হয়। মন্দির দালানে সেই কাঠামো রেখে শান্তি জল দেওয়া হয়। এরপর সাদা কাগজে লাল কালী দিয়ে "শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায়" লেখা হয় পরিবারের সকলে মিলিত হয়ে। প্রাচীনকাল থেকে এই রীতি চলে আসছে। সপ্তমী, অষ্টমীর সন্ধিক্ষণ পুজো ও নবমীতে ছাগ বলির পাশাপাশি ফল বলিও দেওয়া হয়।

publive-image

ঠাকুর মন্দিরের প্রবেশ পথের বাঁ দিকে রয়েছে বংশের প্রাচীন শিব মন্দির, আর ডান দিকে অর্থাৎ মন্দিরের উল্টো দিকে রয়েছে বংশের প্রাচীন রাসমঞ্চ এবং আরেকটি শিব মন্দির। মন্দিরের পিছনে রয়েছে নারায়ণ ঘর, যেখানে নিত্য পুজো হয় সব দেব-দেবীর। একই বংশের পুরোহিতরা নিয়মিত পুজো করে আসছেন। হুগলির দামোদর নদীর ওপার থেকে এখনও এক বংশের ঢাকীরা ঢাক বাজাতে আসেন এবং প্রতিমা তৈরিতে নিপুণ প্রাচীন শিল্পীদের বংশধররা কাজ করেন। ডাকের সাজ দিয়েও প্রাচীন কালের সোলা শিল্পীরা বর্তমান শিল্পীদের সঙ্গে মিলিত হন। নবমী রাতে ঢাকীদের বিশেষ রঙ বাজনা দেখতে এলাকার অনেক মানুষ মন্দির চত্বরে সমবেত হন। হাঁড়ি কাঠ বসে গেলে বাড়ির বিধবা মহিলারা ভাত খান না। দুর্গার পাশাপাশি দোল পূর্ণিমায় নারায়ণ এনে পুজো করা হয়। রাস পুজো, চাঁচো ইত্যাদি প্রাচীন পুজোও এখনও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মন্দির চত্বরে।

বংশের এক প্রবীণ সদস্য অসীম সিংহ জানান, বোধন শুরু হলে বাড়ির কেউ ক্ষার দিয়ে জামাকাপড় কাচতে পারেন না। একবার বোধনের পর কেউ পুকুরে কাপড় ধুচ্ছিলেন, তখন এক মহিলা এসে বলেছিলেন, "সিংহ বাড়ির পুজো শুরু হয়ে গেছে, তোরা এখনো কাপড় ধোয়ার কাজ করছিস," বলেই সেই মহিলা অদৃশ্য হয়ে যান। সেই থেকে বোধন বসে গেলে সাবান কাঁচা, ক্ষার কাঁচা বন্ধ থাকে, দশমীতে বিসর্জনের পর ক্ষার কাঁচা হয়।

publive-image

বর্তমান প্রজন্মের সদস্যা সৌমিলী সিংহ জানান, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত বাড়িতে প্রচুর লোক হয় এবং সেখানে অনেক হইহুল্লোর হয়। তিনি বলেন, "আমরা এই সময়টাতে মেতে থাকি এবং কোনো প্যান্ডেলে যাই না। উল্টো রথের দিন কাঠে ঘা দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। এরপর এক মেটে, তিন মেটে সব কিছুই ঠাকুর দালানে বসে দেখে উপভোগ করি। কিছু ভিডিওও তৈরি করি।" তিনি আরও জানান, অষ্টমীর সন্ধি পুজো বা নবমীর হোমের সময় মা অভয়ার দিকে তাকানো যায় না। "মনে হয় মা যেন জীবন্ত," বলেন তিনি। নবমীতে তিনি অনুভব করেন, মায়ের চোখে যেন জল এসেছে, যেন ঠাকুর ভাবছেন, "এবার হয়তো বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।" সৌমিলী বলেন, "এতটাই জাগ্রত আমাদের অভয়া।"