পুকুরে মাগুর মাছ চাষের পদ্ধতি

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মাগুর মাছ হল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জিওল মাছ। ভারত, পাকিস্তান, চীন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এই মাছটির বিস্তার দেখা যায়। অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের উপস্থিতির ফলে এই মাছ জলের বাইরে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে এবং বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। তাই এই ধরণের মাছগুলিকে জিওল মাছ বলা হয়। উপরিউক্ত কারণগুলির জন্য, পুকুরে চাষ করার জন্য মাগুর মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজাতি। সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরে মাগুর মাছের চাষ করা হয় - ১) একক ভাবে মাগুর মাছের চাষ। ২) পোনা ও মাগুর মাছের একত্রিত চাষ। এককভাবে মাগুর মাছ চাষ করতে ৫-৬ মাস সময় লাগে। ২ থেকে ৩ ফুট গভীরতাযুক্ত ছোট অগভীর পুকুরগুলিকে মাগুর মাছ চাষের জন্য আদর্শ বলে বিবেচনা করা হয়। এই মাছ চাষের জন্য পুকুরের আদর্শ আকার ০.০২ থেকে ০.১৩ হেক্টরের মধ্যে হলে ভালো হয়। মজা ও পতিত জলাভূমিতেও এই মাছের চাষ করা সম্ভব। পুকুরের পাড়ে ইঁদুরের গর্ত করার প্রবল সম্ভবনা থাকায় পুকুরের পাড় উঁচু ও মোটা করে বাঁধানো দরকার। তাই এই সমস্যাগুলির থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক ফুটের মত উঁচু প্রাচীর পুকুরের পাড়ের ওপর তৈরী করা দরকার। তবে এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচা বেশী হয়, তাই অনেক সময় জালের বেড়া দিয়েও পুকুরের পাড় ঘিরে দেওয়া হয়। পুকুরের জলজ আগাছা প্রথমে পরিস্কার করে মাটি শুকিয়ে নেওয়া দরকার। তারপর অপ্রয়োজনীয় মাছ তুলে ফেলার জন্য পুকুরে 'মহুয়া-খোল' প্রয়োগ করা হয়। মহুয়া খোল প্রয়োগের ৭ দিন পর চুনগোলা জল সমান ভাবে পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে। চুন প্রয়োগের পরের দিন তলার মাটি ভালো করে নাড়িয়ে দিতে হবে। এটিকে পুকুরে মাগুর মাছের খাদ্য উৎপাদনের একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। এতেও যদি পুকুরে খাদ্যকণা সঠিক ভাবে প্রস্তুত না হয় তাহলে বিঘা প্রতি ১৫০০-২০০০ কেজি গোবর-সার প্রয়োগ করা দরকার।  ৫০০০-৭০০০ সংখ্যক মাগুর মাছের চারা পুকুরে ছাড়া যেতে পারে। চারাগুলি সুস্থ, সবল এবং ২ ইঞ্চি লম্বা হওয়া দরকার। চারা গুলিকে পুকুরে ছাড়ার আগে অবশ্যই লিটার প্রতি ৮ থেকে ১০ ফোঁটা ফরমালিন যুক্ত জলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে শোধন করে নিতে হবে। মাগুর চাষে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে চুন ও সারের মিশ্রণ প্রয়োগ করা হয়। তাই ১২৫ থেকে ১৫০ কেজি কাঁচা গোবর সার এবং ১০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। মাসে একবার করে অন্তত মাছের নমুনা সংগ্রহ করে তাদের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির হার পরিমাপ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় পরিপূরক খাদ্যের পরিমাণকে বাড়ানো বা কমানো হয়। মাগুর মাছ সাধারণত ৫-৬ মাসে বিক্রির উপযোগী হয়, যখন এটি বিঘা প্রতি ৫৫০ থেকে ৭৫০ কেজি মত উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে।  মাগুর মাছের চাষের ক্ষেত্রে পরিপূরক খাদ্যের প্রয়োগ ও ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা মাগুর মাছের চারা পুকুরে ছাড়ার পরের দিন থেকে সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। পরিপূরক খাদ্য হিসেবে সাধারণত চালের গুঁড়ো, সরষে খোল এবং মাছের গুঁড়ো এই তিনটি উপাদানকে ১:১:১ করে মিশিয়ে পুকুরে পরিবেশন করা হয়। প্রতিদিন পরিপূরক খাদ্য সাধারণত মাছের দৈহিক ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে দেওয়া হয়। কিছু কিছু পুকুরে মাগুর ও পোনা মাছের চাষ একত্রিত ভাবেও করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পুকুরের নিচের স্তরে দ্বিগুণ সম্ভব মাছ ছাড়া হয়। সেই জন্য পুকুরের নীচের স্তরে বসবাসকারী মাছ যেমন, মৃগেল ও সিপ্রিনাস কার্পের সংখ্যাকে কমিয়ে দিয়ে মাগুরের চারার সংখ্যা বাড়ানো হয়। মাছের চারাগুলি কমপক্ষে ৫ সেমি. লম্বা হওয়া দরকার। মাগুর মাছকে আলাদা করে কোনো খাবার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই মাছ পোনা মাছের খাবারই এরা খায়। পুকুরের নীচের স্তর বাদ দিয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ মাগুর চারা বিঘা প্রতি মজুত করা হয়। পুকুরে মাগুর মাছের চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং লাভদায়ক একটি ব্যবসা। কিন্তু পুকুরে এই মাছের চাষের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার, না হলে লাভের পরিবর্তে ব্যবসায়ীর ক্ষতির সম্ভবনা বেশী থাকে। যদি পুকুরে জলের গভীরতা কম থাকে, তবে জলের উষ্ণতা অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ে। যেহেতু মাগুর মাছ চাষে, পুকুরে জলের গভীরতা ১ মিটার রাখলে উষ্ণতা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে থাকে, তাই পুকুরে জলের গভীরতা এই পরিমাণ বজায় রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়াও জলে শ্যাওলার আধিক্য হলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায় এবং জলের স্বচ্ছতা হ্রাস পায়। তাই এই সমস্যার প্রতিকার করার জন্য, জলে পরিপূরক খাদ্যের সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে এবং জল বদলাতে হবে মাঝে মাঝে। এই ধরণের সতর্কতাগুলির কথা মাথায় রেখে, যদি পুকুরে মাগুর মাছ চাষ করা যেতে পারে, তবে প্রভূত লাভের সম্ভবনা আছে।