বাংলাদেশে ভয়াবহ হবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি

author-image
New Update
বাংলাদেশে ভয়াবহ হবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি

হাবিবুর রহমান, ঢাকা: ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে মহামারী করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সীমান্ত এলাকা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ জুড়ে করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে শুরু করেছে। আক্রান্ত শনাক্তের হার নিরিখে রাজধানীসহ দেশের ৪১ জেলাকে অতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত মার্চ-এপ্রিলের চেয়েও করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞরা। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবারই ৬ হাজার ৫৮ জন মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যা ৭২ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে। এছাড়াও গত ২৪ ঘন্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত, শনাক্ত কিংবা সংক্রমণের হার দুই সূচকেই দ্রুত অবনতি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার করোনা পরিস্থিতির। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়েও ভয়ানক হতে পারে এবারের পরিস্থিতি।

বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরো ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৫৫ ও নারী ২৬ জন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬২, বেসরকারি হাসপাতালে ১৪ এবং বাসায় ১০ জন মারা যান। এ নিয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৩ হাজার ৮৬৮ জনে। একই সময়ে নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরো ৬ হাজার ৫৮ জন। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ জনে।



বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, সরকারি ও বেসরকারি ৫৫৪টি ল্যাবরেটরিতে ৩০ হাজার ৯৯৪টি নমুনা সংগ্রহ ও ৩০ হাজার ৩৯১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ৬৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬টি। এতে নতুন করে ৬ হাজার ৫৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার হিসাবে শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।



এদিকে, একদিনে সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ২৩০ জন। এ নিয়ে দেশে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল সাত লাখ ৯৪ হাজার ৭৮৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত ৮১ জনের মধ্যে দশোর্ধ্ব একজন, বিশোর্ধ্ব আটজন, ত্রিশোর্ধ্ব নয়জন, চল্লিশোর্ধ্ব নয়জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ১৮ জন এবং ষাটোর্ধ্ব ৩৬ জন।



বিভাগওয়ারি হিসাবে, মৃত ৮১ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৩ জন, চট্টগ্রামে ৭ জন, রাজশাহীতে ২০ জন, খুলনায় ২৩ জন, বরিশালে ৩ জন, সিলেট বিভাগে ৫ জন, রংপুর বিভাগে ৭ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে বুধবার সারাদেশে ৮৫ জনের মৃত্যু এবং ৫ হাজার ৭২ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত বুধবার নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।



এবার করোনার তৃতীয় ঢেউ এলে দেখা যাবে চিকিৎসার অভাবে বাবার কোলে সন্তান, সন্তানের কোলে বাবা-মা মারা যাচ্ছেন। গত মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল। আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয় ঢেউ এলে পরিস্থিতি হবে আরো করুণ।



সূত্র জানায়, দুই সপ্তাহ আগেও রাজধানীতে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুতই পাল্টাতে যাচ্ছে পরিস্থিতি। লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে গত বুধবার তা ছাড়িয়ে গেছে ১৫ শতাংশ। আর দশ দিনের ব্যবধানে আক্রান্ত শনাক্ত দুই শোর ঘর থেকে বেড়ে দুই হাজার ছাড়িয়েছে।



চলতি মাসের শুরুতে রাজধানীতে চারজনের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে দু’জনের দেহেই কোভিডের ডেল্টা ধরন পাওয়ার তথ্য জানায় আইইডিসিআর আর গত সপ্তাহে আক্রান্তদের ৬৮ শতাংশের দেহে ডেল্টা ধরন পাওয়ার কথা জানায় আইসিডিডিআরবি। অতি সংক্রামক এ ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে ধীরে ধীরে রোগী চাপ বাড়তে শুরু করেছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেও।



এদিকে, আক্রান্ত শনাক্তের হারের পরিপেক্ষিতে রাজধানীসহ দেশের ৪১ জেলাকে অতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সীমান্ত এলাকা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবয়নে ব্যর্থতার মাসুল দিতে হচ্ছে এখন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মার্চ-এপ্রিলের চেয়েও ভয়াবহ হবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।



জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধ জরুরি। কর্মপরিকল্পনা একটা নেওয়া দরকার। যাতে করে শুধু এই হঠাৎ করে লকডাউন বা অবরুদ্ধ না দিয়ে বরং সবগুলো নিয়ে কাজ করা। এমন একটা সংক্রমণ চক্রের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি, এখন বহু সংক্রমণ চক্র তৈরি হয়েছে, এই সবগুলো সংক্রমণ চক্র যদি একসঙ্গে হয়ে যায় তখন আমাদের জন্য আসলেই ভয়ানক পরিস্থিতি দাঁড়াবে। এই মার্চ-এপ্রিলে যে দুঃসহ স্মৃতি তার চেয়েও ভয়াবহ স্মৃতি হবে না, এটা কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তিনি আরো জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষা বাড়ানো, আক্রান্তদের আইসোলেশন নিশ্চিতের পাশাপাশি জোর দিতে হবে রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার ওপর।



কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আমহেদ বলেন, আসল সমস্যা হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি যেহেতু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়েছে। সুতরাং আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো সবার আগে আক্রান্ত হয়েছে। এবার কিন্তু সীমান্ত এলাকা থেকে রাজধানীর দিকে আসছে।    



আইইডিসিআরের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, গণপরিবহন, ফেরিঘাট ও দোকানপাট এই তিন জায়গায় ঝুঁকি বেশি। সামনে ঈদ আসছে। ঈদের পর সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা। সব কাজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা সম্ভব। কিন্তু আমরা কেউই তা করছি না। এতে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।