নিজস্ব প্রতিনিধি,গোয়ালতোড় : সেই কবে মেয়ের রূপে রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার দড়িটি ওপার থেকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্যামা। মায়ের সেই রূপ প্রত্যক্ষ করার পরই রামপ্রসাদ মায়ের কাছে বর চেয়ে বলেছিলেন, “চাইনে মা গো রাজা হতে….আমার মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা, পাই যেন তায় খড় জোগাতে।” সেই থেকে করাল বদনী কালিকাও বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে রয়ে গেছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর চক্রবর্তী বাড়ির পুজো এমনই এক মানব পুজোরই বিচিত্র রূপ। দেবী এখানে শুধুই কন্যা রূপেন সংস্থিতা নন পাশাপাশি বিবাহিত দম্পতি এখানে পূজিত হন পিতৃমাতৃ জ্ঞানে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে এই মাতৃ আরাধনার মধ্যে উর্বরতার উপাসনা প্রাচীন এক আচরনকেই খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে মা কালী পুজোর পূর্বে বাড়ির এয়োস্ত্রীদের মাতৃ রুপে এবং বিবাহিত পুরুষদের পিতৃরূপে পুজো করা হয়।
পরিবারের এই অদ্ভুত পুজো প্রকরনের ইতিহাস প্রসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর ভাদুতলার চক্রবর্তী পরিবার জানিয়েছেন, এই পুজোর প্রধান ও প্রথম পুরুষ গৌরমোহন চক্রবর্তী ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। পুজো অর্চনা নিয়েই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন, পাশাপাশি তিনি একটি সংবাদ পত্রে সাংবাদিকতার কাজও করতেন৷ বাড়িতে নিত্য শালগ্রাম শিলার পুজো না করে তিনি জল স্পর্শও করতেন না৷
পরিবার সূত্রে জানা যায়, একদিন সন্ধ্যে বেলায় নারায়নের পুজো করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন গৌরমোহন চক্রবর্তী। কিন্তু ঘুম তার কিছুতেই ধরছে না। তারপর মাঝরাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসেছে, ঠিক সেই সময় আলোর এক ঝলকানিতে চোখ যেন বন্ধ হয়ে যায়, সেই অবস্থায় মা কালী তাকে স্বপ্নাদেশ দেন বাড়িতেই তার পুজো করার। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়ে যান তার এই পুজোতে কোনও পশুবলি না দিয়ে পরিবারের বিবাহিত পুরুষ ও এয়ো স্ত্রীদের পিতৃমাতৃ জ্ঞানে পুজোর মধ্য দিয়েই তার পুজো শুরু করা হয়৷ এই বলেই মা বিলীন হয়ে যান আর আলোর ঝলকানিও হারিয়ে যায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে চোখ মেলে দেখেন কোথাও কেউ নেই কিন্তু তখনও তার কানে অনুরনন হচ্ছে তোর বাড়িতে আমার প্রতিমা প্রতিষ্ঠা কর।
সকালে উঠেই গৌরমোহন বাবু নিজের স্ত্রী গীতারাণীকে স্বপ্নাদেশের কথা জানান এবং মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা বাড়িতে করবেন তার সিদ্ধান্ত নেন৷ কিন্তু পুজোর বাকি মাত্র হাতে গোনা আর কয়েকটি দিন৷ এই অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে সমস্ত আয়োজন করবেন এই নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লেন চক্রবর্তী দম্পতি। কথায় আছে, “তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি “। ঠিক সেই ভাবেই মা কালী তার আরাধনার সমস্ত কাজ চক্রবর্তী দম্পতির মাধ্যমে করে নেন। তারপর সেই নির্ঘণ্ট দিনে এক ঘোর অমানিশার রাত্রে চক্রবর্তী বাড়িতে শুরু হলো মা কালীর আরাধনা। পুজোর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল শিশু কন্যাদের কুমারী পুজো। পরিবারের সমস্ত শিশু কন্যাকেই দেবী জ্ঞানে পুজো করা হয়। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মানব আরাধনা এই চক্রবর্তী পরিবারে।
বাঙলা ১৩৭০ সালে প্রথমে নিজের মাটির বাড়িতে মায়ের মন্দির নির্মাণ করে পুজো শুরু করেন গৌরমোহন চক্রবর্তী। পরে তার মৃত্যুর পর এই মায়ের আরাধনার দায়িত্ব নেন তার দুই পুত্র বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও সুরজিৎ চক্রবর্তী। বর্তমানে সেই মাটির মন্দিরের পরিবর্তে সুরম্য কংক্রিটের মন্দিরে পাথরের প্রতিমা নির্মান করা হয়েছে৷ পুজো উপলক্ষ্যে ভাদুতলা সহ পাশাপাশি গ্রামের মানুষ একত্রিত হয় এই চক্রবর্তী বাড়িতে। তিন দিন ধরে চলা এই পুজোতে আয়োজন করা হয় অন্নকূটের। এছাড়াও প্রতি অমাবস্যার পুজোতে বহু ভক্ত সমাগম ঘটে।
পুজোর আয়োজক বিশ্বজিৎ ও সুরজিৎ বাবু জানান, তাদের এই পুজোতে নেই কোনো বলি প্রথা। কারন প্রয়াত গৌরমোহন চক্রবর্তী কে মা স্বপ্নাদেশ দেন বলির রক্তে উপাচার না দিতে৷ পাশাপাশি পুজো শুরুর আগে পিতৃমাতৃ পুজো ও কুমারী পুজো করা হয়। পুজোর কয়েকদিন আগের থেকেই চক্রবর্তী বাড়িতে ব্যাস্ততা শুরু হয়ে যায়,দুর দুরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন আসেন, গ্রামের সমস্ত মানুষ মিলিত হয়। ফলে তখন চক্রবর্তী বাড়ির এই কালী পুজো হয়ে উঠে এলাকার পুজো৷
তবে এবার করোনার কারণে চক্রবর্তী বাড়ির এই কালী পূজো কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে পড়েছে। আসেন নি দুরদুরান্তের আত্মীয়স্বজন, আয়োজনেও ভাটা পড়েছে খানিকটা।
চক্রবর্তী বাড়িতে কালী যেন কন্যা রূপেনু সংস্থিতা
New Update