হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বাংলাদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা
ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের তিন মাস পর সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। সারা
বাংলাদেশে ডেল্টার তাণ্ডব এখন কিছুটা স্তিমিত। সংক্রমণের হার গতমাসে ৩২
শতাংশে উঠে গেলেও এখন তা কমে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে বাংলাদেশে
করোনার আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত হয়েছে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি
পেরুর ল্যাম্বডা (সি.থার্টি সেভেন) নামে পরিচিত, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের
২৮টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীতে ৪৯ বছর বয়সী এক মহিলার নমুনা
সিকোয়েন্সিং করে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মার্চ মাসে
সংগ্রহ করা নমুনায় ল্যাম্বডার উপস্থিতি পাওয়া যায় বলে একাধিক সূত্র
নিশ্চিত করেছে। তবে বাংলাদেশে পাওয়া ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টে তেমন কোনো
ক্ষতিকর মিউটেশন দেখা যায়নি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালানো ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে পাওয়া গেছে
গত ৮ মে। ভারত ফেরত কয়েকজন ব্যক্তির নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়
জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। এরপর একে একে আরো পাওয়া যায় ডেল্টা
ভ্যারিয়েন্ট। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান
(আইইডিসিআর) মে মাসের মাঝামাঝি থেকে যেসব করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স
করেছে, তার ৮০ শতাংশেই পাওয়া যায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এরপর থেকে শুরু হয়
করোনার উচ্চমুখী সংক্রমণ। এর তিন মাস পর এখন মধ্য আগস্টে সংক্রমণের হার
নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, দেশের সীমান্তবর্তী সাত জেলায় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট
তান্ডব চালায়। এসময় বহু মানুষ ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে শনাক্ত ও
মৃত্যু হয়েছে। দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর
করোনা পরিস্থিতির অবনতির হতে থাকে সাতক্ষীরা জেলায়। সেখান থেকে পরিস্থিতি
আরও অবনতি ঘটে পুরো খুলনা বিভাগের। খুলনা বিভাগের প্রায় সব জেলাতেই
সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ,
বাগেরহাট, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় সংক্রমণ বেড়ে যায়।
এরপর পরিস্থিতি পাল্টায় রংপুর বিভাগে। এই বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট,
ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে বাড়তে থাকে করোনা রোগী। এরমধ্যে দিনাজপুরে সবচেয়ে
বেশি সংক্রমণ বাড়ে। দিনাজপুরের সঙ্গে বাড়তে থাকে চট্টগ্রাম জেলায় করোনা
রোগী। এরপর ঢাকা বিভাগেও দেখা দেয় করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। এই
বিভাগের ফরিদপুরে প্রথমে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এরপর গোপালগঞ্জ, গাজীপুর,
কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং রাজবাড়িতে বেড়ে যায় শনাক্তের হার। এরপর একে একে
সারাদেশে ডেল্টার তাণ্ডব দেখা দেয়।
ঢাকায় করোনা শনাক্তের হার নিম্নমুখী থাকলেও তা বেড়েছে ১৯ জুন থেকে। তার
আগের দিন করোনায় শনাক্ত ছিল ৪৭৩ জন। ১৯ জুন শনাক্ত হয় ১ হাজার ১১৪ জন।
এরপর শুধু ঢাকা নয় সারাদেশেই করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যু বাড়তে থেকে। জুন
মাস শেষ হওয়ার আগেই একদিনে শনাক্ত প্রায় ৯ হাজারের কাছাকাছি চলে যায়, যা
এর আগে কখনও হয়নি। মে মাসে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত ছিল ১ হাজার ৭১০ জন।
জুলাই মাসে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ২৩০ জন। জুলাই মাসে ঈদের
সময় নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় শনাক্ত কম ছিল। কিন্তু পুরো মাসেই গড়ে ১০
হাজার করে করোনার আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। আর তাতে করে চাপে পড়তে থাকে
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে।
দেশে করোনার সংক্রমণ যখন বাড়ছিল তখন একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল মৃত্যুর
মিছিল। পুরো মে মাসজুড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন হলেও জুনে
বাড়তে বাড়তে মৃত্যু ১১৫ পর্যন্ত হয় একদিনে। জনে মোট শনাক্ত হয় ১ লাখ ১২
হাজার ৭১৮ জন এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৮৮৪ জনের। জুলাইতে শনাক্ত বেড়ে
দাঁড়ায় ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জনে এবং মৃত্যু হয় ৬ হাজার ১৮২ জনের। জুলাইয়ের
মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ২৫০ জন মারা
গেলেও ১২ আগস্ট থেকে মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। ১২ আগস্ট মৃত্যু হয় ২১৫
জনের, ১৩ আগস্ট ১৯৭ জনের, ১৪ আগস্ট ১৭৮ জনের এবং ১৫ আগস্ট ১৮৭ জনের
মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
১২ আগস্ট থেকে শনাক্ত ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সর্বশেষ গত শনিবার শনাক্ত
হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৪ জন। আর ১৩ আগস্ট থেকে শনাক্ত নেমে আসে ১০ হাজারের
নিচে। জুলাইয়ের পুরো মাসে গড়ে প্রতিদিন ১১ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে।
শনাক্তের হার জুলাইতে ৩২ শতাংশ হলেও তা বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি কমতে শুরু
করেছে। গতমাসেও আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। সংক্রমণের হার
৩২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এখন এটা কমে গিয়ে ২০ শতাংশের মধ্যে চলে এসেছে।
তবে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছু কমলেও আমরা সন্তুষ্ট নই, আমরা ৫ শতাংশের নিচে
সংক্রমণ চাই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ডা. আবু
জামিল ফয়সাল বলেন, এভাবে যদি কমতে থাকে, তাহলে অবশ্যই বলা যাবে আমাদের
সংক্রমণের হার কমে আসছে। কিন্তু আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, টেস্ট
কতটুকু হচ্ছে। গত কয়েকদিনে ৪০-৫০ হাজার পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে। সেখান থেকে
৩০ হাজারে নেমে আসছে। যার কারণে সংক্রমণের হারও কমে আসছে। সেজন্য আমাদের
সব দিকেই খেয়াল রাখতে হবে।
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নতুন আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত
হয়েছে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি পেরুর ল্যাম্বডা (সি.থার্টি সেভেন) নামে
পরিচিত, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের ২৮টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি
জার্মানির গে¬াবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (জিআইএসএআইডি)
থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সেখানে জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করেছে
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। জিনোম সিকোয়েন্স
যৌথভাবে করেছে বিসিএসআইআর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকায় ৪৯ বছর বয়সী এক মহিলার নমুনা সিকোয়েন্সিং করে এই ভ্যারিয়েন্টের
উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মার্চ মাসে সংগ্রহ করা নমুনায় ল্যাম্বডার উপস্থিতি
পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ মিউটেশনই উদ্বেগের
কারণ না হলেও যখন স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন হয় এবং ভাইরাসের বিপজ্জনক
চরিত্রগত পরিবর্তন হয় তখন সেটি বিশাল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে
স্বস্তির বিষয় হলো, বাংলাদেশে পাওয়া ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টে তেমন কোনো
ক্ষতিকর মিউটেশন দেখা যায়নি। ফলে বাংলাদেশে চলমান ভ্যাকসিন প্রয়োগ
কার্যক্রমে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেশে এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে একটি নমুনায়
ব্রাজিলের গামা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছিল। মার্চের নমুনায় পাওয়া গেছে
ল্যাম্বডা। এরপর দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও কোনো নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্টগুলো
পাওয়া যায়নি। তার মানে এগুলো বাংলাদেশের পরিবেশে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার
করতে পারেনি। যেমনটা পেরেছে ডেল্টা। তাই ল্যাম্বডা বা গামা নিয়ে
দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে ভ্যারিয়েন্ট যাই হোক না কেন সংক্রমণ এড়াতে
চাইলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কারণ ভাইরাস বিভিন্ন সময়ে মিউটেশন
হতেই পারে রূপ পাল্টানোর মাধ্যমে। আর তাই ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও বেশি
গুরুত্বপূর্ণ মাস্ক পরে সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট তালিকায় থাকা
ল্যাম্বডা দ্রুত বিস্তার লাভের ক্ষমতার জন্যই নয়, পেরুতে সবচেয়ে বেশি
মৃত্যুর জন্যেও এটি পরিচিত। এটি বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ
পর্বতমালার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়াও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল,
কলম্বিয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ কমপক্ষে ২৮টির বেশি দেশে এই ল্যাম্বডা
ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কাতারের দোহা কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের সহকারী
অধ্যাপক মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান বলেন, করোনাভাইরাস একটি জঘন্য ভাইরাস এবং
এটি স্বাভাবিক যে এখানে মিউটেশন হবে। অধিকাংশ মিউটেশনই উদ্বেগের কারণ না
হলেও যখন স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন হয় এবং ভাইরাসের বিপজ্জনক চরিত্রগত
পরিবর্তন হয় তখন সেটি বিশাল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে তাণ্ডব কমছে প্রাণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের
New Update