হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বাংলাদেশ ও বাঙালির সবচেয়ে হদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী শোকের দিন রোববার ১৫ আগস্ট। গোটা জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে পালিত হবে জাতীয় শোক দিবস। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বলয়।
ঢাকা ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় মোতায়েন থাকবে সর্বোচ্চ সংখক র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্য। ১৫ আগস্ট ঘিরে কোনো ধরনের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসতে চায়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ মেধা ও চেষ্টা দিয়ে সব ধরনের অপতৎপরতা রুখে দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল এ কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৬ বছর আগে এ দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল। বাঙালির মুক্তির মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা। সে রাতে ঘাতকদের বুলেটে ঝাজরা করে দেয় জাতির জনকের বুক। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, সেই রাতে ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় বঙ্গমাতা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের ১৬ সদস্যকে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাংলাদেশের বাইরে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। প্রতি বছর দিনটি আসে বাঙালির হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। পুরো জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে।
আগস্ট মাস এলেই অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধে। নাশকতা ও জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসে। সাজানো হয় নিরাপত্তা ছক। দেশি-বিদেশি জঙ্গিরা আগস্ট মাস ঘিরে আত্মঘাতী বা টাইম বোমা হামলার পরিকল্পনা করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট। বিশেষ করে পলাতক ও জামিনে মুক্ত জঙ্গিদের ব্যাপারে নেয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আর্জেস গ্রেনেড হামলা, এরপরের বছর ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা এবং ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে শোক দিবসের র্যালিতে আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হলে আগস্ট মাস ঘিরে বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়। বাড়ানো হয় গোয়েন্দা কার্যক্রম। তবে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগস্ট মাস ঘিরে নাশকতার কোনো আশঙ্কা নেই। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। রয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা।
পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ডিআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টের নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক হয়েছে।
সেখানে সারাদেশে বাড়তি সতর্কতা এবং নজরদারির ব্যাপারে সজাগ থাকতে পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পলাতক ও জামিনে থাকা জঙ্গিদের ব্যাপারে তথ্য হালনাগাদ থাকতে বলা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা পরিকল্পনায় ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও বনানী কবরস্থানকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আগস্টের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে র্যাব মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আগস্ট মাস ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। এই মাসে বিশেষ দিবস ঘিরে বেশ কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচি যাতে নির্বিঘ্ন হয় সেজন্য পোশাকে ও সাদা পোশাকে র্যাব তৎপর রয়েছে। জঙ্গিদের কোনো ধরনের হামলার সক্ষমতা নেই এমন তথ্য থাকলেও র্যাব আত্মতুষ্টিতে ভুগছে না। যে কোনো জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি র্যাবের রয়েছে। চিহ্নিত জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা ও কার্যক্রম সম্পর্কে সবসময় খবর রাখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা ও আশপাশের একাধিক জেলায় জঙ্গি আটকের ঘটনা ঘটেছে। এসব আস্তানায় বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। ঘাঁপটি মেরে থাকা জঙ্গিরা যে কোনো সময় মাথাচাড়া দিতে পারে এমন আশঙ্কা সবসময়ই। বিশেষ করে আগস্ট মাস ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জঙ্গিরা নাশকতার পরিকল্পনা করতে পারে এমন খবরও পুরনো। চার বছর আগে আগস্টের শোক র্যালিতে হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৬ আগস্ট শোক দিবসের আলোচনা সভা, ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদ সভা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মসূচি রয়েছে। দিবসগুলোতে দেশব্যাপী কর্মসূচি পালিত হয়। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে টার্গেট করে নাশকতা করতে পারে এমন গোয়েন্দা তথ্যে নিরাপত্তা জাল বিস্তৃতি করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ নেতাকর্মী আহত হন। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে রাজধানীসহ দেশের ৬৩ জেলায় সকাল ১১টায় সিরিজ বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। দেশের ৩০০ স্থানে মাত্র আধাঘণ্টার ব্যবধানে একযোগে ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
এতে সাভারে সালাম নামে এক শিশু নিহত ও দুই শতাধিক লোক আহত হয়। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধাসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে। হামলার স্থানগুলোতে জেএমবির লিফলেট পাওয়া যায়।
লিফলেটগুলোতে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। তাতে লেখা ছিল, দেশের কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠালাম। দ্রুত দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমত কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব, যারা বিচারক আছেন তারা তাগুতি (মানবসৃষ্ট) আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন। নতুবা আরো ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ সর্তকবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে।
সিরিজ বোমা হামলায় সারা দেশের বিভিন্ন থানায় ১৬১টি মামলা হয়। জঙ্গিবাদে মদত দেয়ার অভিযোগে বিএনপি নেতা ও সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী আলমগীর কবির, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা ও শীষ মোহাম্মদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জঙ্গিবাদে মদত দেয়ার অভিযোগে ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ৩১ বছরের সাজা হয়।
২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার পান্থপথে ওলিও হোটেলে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় এক জঙ্গি।
এ সময় বিধ্বস্ত হয় ভবনের একটি অংশ। নিহত জঙ্গির নাম সাইফুল ইসলাম। ১৫ আগস্টের শোক র্যালিতে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানই ছিল তার উদ্দেশ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন ‘আগস্ট বাইট’ শেষে এ তথ্য জানানো হয়। ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টা, হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। ঘটনাস্থল রাসেল স্কোয়ারে ওলিও নামের এ আবাসিক হোটেল, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু জাদুঘর থেকে মাত্র ২৫০ গজ দূরে।
ভেতরে বোমা বহনকারী জঙ্গি অবস্থা করছে, এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, আগের দিন রাত থেকেই হোটেল ভবনটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বারবার আত্মসমপর্ণের জন্য বলা হলেও, ভেতর থেকে কোনো সাড়া মেলেনি, পরে তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় গুলি। এরই একপর্যায়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় সে। এরপরও আগস্ট মাস ঘিরে নাশকতার পরিকল্পনা থেমে নেই।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের আহ্বানে কিছু বাংলাদেশি ঘর ছেড়ে ‘হিজরতে’ বেরিয়েছেন। ১৫ আগস্ট ঘিরে কোনো ধরনের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। এ দিনকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসতে চায়। তবে আমরা সর্বোচ্চ মেধা ও চেষ্টা দিয়ে সব ধরনের অপতৎপরতা রুখে দিতে প্রস্তুত আছি।
ডিএমপি কমিশনার আরো বলেন, সমগ্র পৃথিবী এখন সাইবার ওয়ার্ল্ডে বন্দি। জঙ্গিরাও একই মিডিয়ায় তাদের রিক্রুট এবং উদ্বুদ্ধ করছে। জঙ্গিদের বিষয়ে সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জঙ্গিরা থেমে নেই এটা বলা যায়। আমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে কোনো ধরনের ঘটনা না ঘটে।