‘বিশেষ সঙ্গ’ দিয়ে অর্থ আয় করতেন পরীমনি

author-image
Harmeet
New Update
‘বিশেষ সঙ্গ’ দিয়ে অর্থ আয় করতেন পরীমনি

হাবিবুর রহমান, ঢাকা : চিত্রনায়িকা পরীমনি গ্রেফতারের পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে আসছে। মেধা ও শরীরকে কাজে লাগিয়ে স্মৃতি থেকে হয়ে উঠেন পরীমনি। তবে মেধাকে পেছনে ফেলে শরীরের যোগ্যতা বাড়িয়ে বিস্তার ঘটায় প্রভাব প্রতিপত্তির। রূপ যৌবনকে কাজে লাগিয়ে মালিক হন প্রায় শত কোটি টাকার। গোয়েন্দা তথ্যে বেড়িয়ে আসছে ‘বিশেষ সঙ্গ’ ও বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নিয়ে অর্থ আয় করতেন পরীমনি। আর তাকে সহযোগিতা করতেন কথিত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ।







তিনি প্রথমে পরীমনিকে কোটিপতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রাজের সঙ্গে মিশু হাসান ও জিসান মিলে ১০ থেকে ১২ জন তরুণী নিয়ে একটি সিন্ডিকেট চালাতেন। উচ্চবিত্ত ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ‘বিশেষ সঙ্গ’ দিয়ে এইসব তরুণীরা অর্থ আয় করতেন। এই চক্রের তরুণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘চাহিদা’ ছিল পরীমনির। তিনি বিদেশে গিয়েও ‘পে¬জার ট্রিপ’ দিতেন। চিত্রনায়িকা পরীমনি গ্রেফতার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিজেই র‌্যাবকে এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।







অপরদিকে আলোচিত চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ সিনেমা ও মডেলিংয়ে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেন। প্রথমে ফাঁদ পেতে তার নিজের বাসায় ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’য় নিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করাতেন। এভাবে প্রায় দুই শতাধিক তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন তিনি। এসব তরুণীর বেশিরভাগের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এ নিয়ে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন রাজ। তার বনানীর বাড়িতে অভিযানেও কম্পিউটার ও মোবাইলে মিলেছে অনেক অনৈতিক গোপন ভিডিও-ছবি। এছাড়াও জব্দ করা হয়েছে তিনটি মেমরি কার্ড।













পরীমনিকে সাভারের বোট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া তুহিন সিদ্দিকী অমির সঙ্গে গত এপ্রিলে দুবাই যান চিত্রনায়িকা পরীমণি। সেখানে ওয়াটার আইল্যান্ড নামে একটি কৃত্রিম দ্বীপে অমির ফ্ল্যাটে থাকেন ১৭ দিন। সেখানেই দুজনের সখ্যতা গাঢ় হয়। দেশে ফিরে অমি পরীমনিকে সাভারের বোট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পরীমনির শ্লীলতাহানির চেষ্টার মামলার আসামিও হন। শুক্রবার তদন্ত সূত্র জানায়, পরীমনিকে মাদকের অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও তদন্তে মিডিয়াকেন্দ্রিক নানা ‘কীর্তি’ জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসছে। মডেলিং ও সিনেমায় অভিনয় করার পাশাপাশি পরীমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে সেখানে ব্যবসায়ীদের দাওয়াত দিয়ে টাকা নিতেন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘুরতেন। পরবর্তীতে টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতেন।







দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে পরীমনির করা মামলায় গ্রেফতার তার ‘বন্ধু’ অমির ফ্ল্যাট রয়েছে দুবাইয়ের ওয়াটার আইল্যান্ড নামে একটি কৃত্রিম দ্বীপে। দ্বীপটি দুবাইয়ের সবচেয়ে দামি জায়গা। সাধারণত সেখানে কোনো বাংলাদেশি ফ্ল্যাট কেনেন না। সেখানে ৪৫ লাখ ইউএই দিরহাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১১ কোটি টাকা) দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন অমি। পরীমনি ২০২১ সালের এপ্রিলে দুবাই গিয়েছিলেন। তার দুবাই যাওয়ার বিমান টিকিট এবং ঘুরাফেরার সব খরচ বহন করেন অমি। সেখানে ১৭ দিন ছিলেন পরীমনি। রাতে অমির ফ্ল্যাটেই থেকেছেন। সূত্র জানায়, অমির সঙ্গে ঘুরাঘুরি ও সময় কাটাতে দুবাই যান পরীমনি। দুবাইয়ে ১৭ দিন থাকার জন্যে পরীমনিকে অমি দিয়েছিলেন নগদ ১৫ লাখ টাকা। এছাড়াও অমি পরীমনিকে দেশে ফিরে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে দেশে ফেরার কিছুদিন পরই বোট ক্লাবের ঘটনায় অমি কারাগারে যান।









দায়িত্বশীল সূত্র আরো জানায়, দুবাইয়ে সেই ফ্ল্যাটে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন চিত্রনায়িকা ও মডেলকে নিয়েছেন অমি। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে পাচার করা মেয়েদের ওই ফ্ল্যাটেই রাখেন তিনি। তবে সেখানে সবচেয়ে বেশি থেকেছেন এনটিভির রিয়েলিটি শো মার্কস অলরাউন্ডার চ্যাম্পিয়ন মডেল রথী। দুবাইয়ে রথী নিজেকে অমির স্ত্রী পরিচয় দেন। এছাড়া এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আরেক মডেল হচ্ছেন শিরিন শিলা। শিরিন শিলা ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার ইসমাঈল চৌধুরী সম্রাটের সহযোগী আরমানের গার্লফ্রেন্ড ছিলেন। আরমান জেলে যাওয়ার পর দেশের একটি বৃহৎ সিটি করপোরেশনের মেয়রের বান্ধবী বলে পরিচয় দেন তিনি। পাশাপাশি শিরিন সবসময় নিজেকে বাংলাদেশ পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বান্ধবী হিসেবে পরিচয় দেন। এই দুজন মূলত মাসিক ভিত্তিতে বড় বড় ব্যবসায়ী ও স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে লিভ টুগেদার করেন। এজন্য তারা ‘মডেল’ পরিচয় ব্যবহার করেন। শিরিন শিলাকে অমির টাকায় মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটও নিয়েছেন। যদিও শিরিন শিলা বর্তমানে আফতাব নগরে নিজ ফ্ল্যাটে থাকেন। এছাড়া এই চক্রে নতুন অভিনেত্রী সোহানা সাবার যুক্ত থাকার কথাও শোনা গেছে। অমির সঙ্গে এসব উঠতি মডেলদের পরিচয় করিয়ে দেন মিডিয়ার একজন পরিচিত ছেলে মডেল। তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। গত ১৩ জুন রাতে ফেসবুক পোস্টে পরীমনি অভিযোগ করেন, গত ৯ জুন উত্তরার বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা চালান ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় তিনি সাভার থানায় ৬ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ‘বন্ধু’ অমির নামও আসামির তালিকায় দেন পরীমনি। পরীমনিকে শ্লীলতাহানির চেষ্টার সহযোগী, মাদক ও মানবপাচারের মামলায় অমি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পরীমনির বাসায় একটা মিনি বার রয়েছে। তিনি বাসায় মাঝে মধ্যেই পার্টির আয়োজন করতেন। এখানে বিভিন্ন ব্যক্তিরা আসতেন। তার এই কাজে সহযোগিতা করতেন নজরুল ইসলাম রাজ। এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।







সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পরীমনি ২০১৪ সালে শোবিজ মিডিয়ায় যুক্ত হন। গত সাত বছরে তিনি ৩০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এর মধ্যেই তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের চেয়ে নিয়মিত বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নেওয়ার নেশা ছিল তার। এছাড়া চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের পর থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। নিয়মিত বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে মদ পান করতেন। এসব পার্টিতে শিল্পতিদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। এরপর দেশের বাইরে বিশেষ করে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে শিল্পপতিদের ‘এসকর্ট’ হিসেবেও কাজ করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি জানিয়েছেন, তার ব্যবহার করা গাড়িটি একটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা কিনে দিয়েছিলেন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা রয়েছে। করোনার মধ্যেই ওই ব্যক্তির সঙ্গে দুবাই ভ্রমণে যান তিনি। এছাড়া বিদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরীমণিকে যোগসূত্র তৈরি করে দিতেন তুহিন সিদ্দিকী অমি।







র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারের পর পরীমনির মোবাইল ফোনটি তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেখানে অনেক ভিআইপি ব্যক্তি ও শিল্পপতিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও বিশেষ সম্পর্ক থাকার অনেক তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। অনেকের সঙ্গে তার নিয়মিত কথপোকথনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এসব ব্যক্তিরা সমাজের উঁচুস্তরের ব্যক্তিবর্গ। তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর করা হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

সংশি¬ষ্ট সূত্র জানায়, পরীমনির সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া অনেক রাজনীতিকের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তার। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক সন্ত্রাসীর সঙ্গেও অর্থের বিনিময়ে ‘বিশেষ সঙ্গ’ দিয়ে অর্থ আয় করেছেন তিনি। একটি সূত্র জানায়, প্রবীণ এক রাজনীতিকের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন তিনি। কথিত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ তাকে ওই রাজনীতিকের বাসায় নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বলেন, পরীমনি ও রাজের বিষয়ে আমরা অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, পরীমনি ও রাজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা দুটি তদন্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবে র‌্যাব।

অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নজরুল ইসলাম রাজ দাবি করেন, কমবয়সী তরুণীদের মধ্যে মিডিয়া সেলিব্রেটি হওয়ার শখ বেশি থাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতেন। আবার অনেক সময় ব্যাকমেইলিংয়ের জন্য গোপনে ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। এ জন্য তিনি বনানীতে অবস্থিত তার বাসাকে বেশি কাজে লাগাতেন।





আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একধিক সূত্র জানায়, রাজের বনানীর বাসাতে পর্নোগ্রাফি তৈরি কনটেন্ট পাওয়া গেছে। বিশেষ করে তার প্রডাকশন হাউজের মাধ্যমে যারা মডেল বা অভিনেত্রী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, তাদের সঙ্গে রাজ কোনো না কোনোভাবে শারীরিক সম্পর্ক করতেন। তাদের অনেককে তিনি বাধ্য করতেন। আবার স্বেচ্ছায়ও অনেকে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতেন। এসব কাজের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে রাখতেন তিনি।

রাজ ব্যবসার পাশাপাশি দেশের বিনোদনজগতে বিচরণ করেন ২০১৪ সালে। এরপর তার সঙ্গে পরিচয় হয় পরীমনির। রাজের হাত ধরেই পরীমনি মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়েন। ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’র কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজ শোবিজজগতে ক্যারিয়ার শুরুর পর নাটক ও সিনেমা প্রযোজনা শুরু করেন। তার রাজ মাল্টিমিডিয়ার অফিসকে তিনি অনৈতিক কার্যক্রমে ব্যবহার করতেন। অভিযানে সে রকম অনেকগুলো পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট জব্দ করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব।





সূত্র আরো জানায়, রাজ কমবয়সী তরুণীদের বেশি টার্গেটে নিতেন। যাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে। কারণ এসব তরুণীর মিডিয়ায় কাজের আগ্রহ বেশি। অনেকে তার হাত ধরে মিডিয়ায় কাজের সুযোগও পেয়েছেন। রাজের বাসায় একটি রুম পাওয়া যায়। যেখানে একাধিক নারী পুরুষের একসঙ্গে সমন্বিত বিকৃত যৌনাচারে ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি ছিল। এটি নজরুল ইসলাম রাজের ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন হাউজের’ একটি কক্ষ বা বিশেষ বিছানা।