New Update
নিজস্ব সংবাদদাতা: ডেভিড লিন, রোমান পোলানস্কি, সত্যজিৎ রায়, জেমস আইভার এই চারজনের মধ্যে কোন যোগসূত্র পাচ্ছেন? হ্যাঁ, এরা সকলেই বিশ্ববিশ্রুত অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক এবং এদের চারজনেই তাদের সিনেমায় একজন বাঙালী অভিনেতাকে কাস্ট করেছেন। তিনি হলেন ভিক্টর ব্যানার্জি।
আজ আমরা যখন ইরফান খান,অনিল কাপুর,অনুপম খের-দের নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে উঠি, হলিউডে আমাদের অভিনেতাদের উপস্থিতির কথা ভেবে গর্বিত হই তখন হয়তো ভুলেই যাই বিদেশে শুধু সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের মত পরিচালকরাই নন, আমাদের বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিদেশে অভিনয়ের জন্য প্রথম পুরষ্কার প্রাপ্ত ভারতীয় একজন বাঙালি। তিনি সুচিত্রা সেন, মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে "সাত পাকে বাঁধা" চলচ্চিত্রের জন্যে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার লাভ করেছিলেন সেই ১৯৬৩ সালে।
অনেকেই জানেননা ভিক্টরের পিতৃদত্ত নাম ছিল পার্থসারথি। মা-বাবা দুদিক দিয়েই তিনি জমিদার বংশের সন্তান। কিন্তু তার শৈশব ও স্কুল জীবনের বড় অংশ কেটেছে শিলং-এ। ছোট থেকেই পাহাড়ি লোকেদের জীবনসংগ্রাম, তাদের পরিশ্রমক্ষমতা ও সততা ভিক্টরকে প্রভাবিত করেছিল। ফলে তাঁর হৃদয়ে পাহাড়ের জন্যে একটা জায়গা বরাবরই ছিল। বরাবর একটা প্রতিবাদী সত্ত্বা নিয়ে চলেছেন।নিজের কর্মজীবনেও সিনেমার এক্সট্রাদের ও টেকনিশিয়ানদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির দাবীতে বহুদিন আন্দোলন করেছেন, তাদের নিয়ে সংগঠন করেছেন।
সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক, তুলনামুলক সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন যাদবপুরে। কলেজ জীবন থেকেই বিভিন্ন গ্রুপে নাটক, থিয়েটার করেছেন। তারপর সত্যজিৎ রায়ের চোখে পড়েন, ১৯৭৭ সালে "শতরঞ্জ কে খিলাড়ী " সিনেমা তে তার চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য পাওয়াকে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন ভিক্টর। বলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতা আমজাদ খান, সঞ্জীব কুমার, সইদ জাফরি ও রিচার্ড এটেনবরোর মত বিশ্ববিখ্যাত ফিল্ম ব্যক্তিত্যের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। পরের বছর মার্চেন্ট-আইভরি প্রোডাকশনের একটি টেলিছবিতে কাজ করেন। ধীরে ধীরে বাংলা মেনস্ট্রিম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পরেন আশির দশকের শুরুতেই। কাজ করে ফেলেছেন শ্যাম বেনেগালের সাথে "আরোহণ " ছবিতে। তারপর এল ডেভিড লিনের "প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া"র অফার।
ডেভিড লিনকে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী চিত্রপরিচালকদের একজন ধরা হয়। তার পরিচালিত Lawrence of Arabia, Bridge on the river kwai, Doctor Zhivago-র মত কালজয়ী সিনেমাগুলি আজও বিশ্বের কোটি কোটি সিনেপ্রেমীর স্মৃতিতে অমলিন। প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা দিলীপ কুমার বৃদ্ধ বয়সে আক্ষেপ করেছিলেন লরেন্স অফ আরাবিয়াতে অভিনয়ের সু্যোগ পেয়েও করে উঠতে পারেননি। সেই রোলটি পরে ওমর শরিফ করেন এবং খ্যাতির শীর্ষে চলে যান। সেই সিনেমায় আরেক বিখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা আই এস জোহরও একটি ছোট রোলে ছিলেন।
যাই হোক, এহেন প্রথিতযশা পরিচালক যখন E.M.Forster-এর ভারতীয় প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস অবলম্বনে "A passage to India" চলচ্চিত্রটির কাস্টিং শুরু করলেন তখন প্রথমে গল্পের প্রোটাগনিস্ট ডক্টর আজিজের রোলে কোন লণ্ডননিবাসী এশীয় অরিজিন অভিনেতাকেই কাস্ট করতে চেয়েছিলেন। তখন খোদ সত্যজিৎ রায় তাঁকে ডক্টর আজিজের রোলে ভিক্টর ব্যানার্জির নাম প্রস্তাব করেন।সালটা ১৯৮২।সেই সময়ে এত বড় ব্যানারের হলিউডি সিনেমার মুখ্য চরিত্রে এক ভারতীয় অভিনেতার নির্বাচন বেশ চাঞ্চল্যকর ব্যাপার ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ভি শান্থা রাও। তিনি চেয়েছিলেন এই গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র করুন। কিন্তু নানা কারণে সেটি সম্ভবপর হয়নি। লিনের তৈরি এই সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি ১৯৮৪ তে মুক্তি পাবার পরে প্রবল প্রশংসিত হয় এবং অস্কারে ৭টি নমিনেশন পায়, ভিক্টর নিজে ব্রিটেনের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরষ্কার মঞ্চ Bafta awards-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার নমিনেশন পান।
আমেরিকার National Board of Review তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান প্রদান করে। এই পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে Al pacino, Jack Nicholson, Peter O'tool, Robert de Nero,Peter sellers এর মতো তাবড় তাবড় অভিনেতারা আছেন।আজ অব্দি সম্ভবত আর কোন ভারতীয় অভিনেতা এমন কৃতিত্ব অর্জন করেননি।
১৯৮৪ সালে একই বছরে সত্যজিৎ রায়ের "ঘরে বাইরে" মুক্তি পায়।"ঘরে বাইরে"-র জন্যে শ্রেষ্ঠ সহ অভিনেতার জাতীয় পুরষ্কার পান ভিক্টর।জীবনে তিনবার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনটিই আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে। এই নজির আর কারুর নেই।
একে একে তিনি হলিউডের বিশিষ্ট পরিচালকদের প্রোজেক্ট যেমন রোমান পোলান্সকির "বিটার মুন", জেরি লন্ডনের সাথে "দাদাহ ইজ ডেথ", রোনাল্ড নিয়েমের "ফরেন বডি" ছবিতে কাজ করেন।
বাংলা মূলধারার চলচ্চিত্রেও নিজের নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে তাঁর অভিনীত "লাঠি" চলচ্চিত্রটি মাসের পর মাস চলেছিল বিভিন্ন বাংলা প্রেক্ষাগৃহে।
এত বর্ণময় কেরিয়ার হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে লাইমলাইটের বাইরেই রেখেছেন বেশীরভাগ সময়ে। বেশকিছু বলিউডি সিনেমায় তাঁকে দেখা গেলেও নিজেকে ইন্ডাস্ট্রির অংশ মনে করতেন না।
ভিক্টর তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন পাহাড়ি অঞ্চলে। ফলে সেখানকার জীবনযাত্রা, সমস্যা তাঁকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছে। ১৯৯০ সালে শুরু হওয়া উত্তরাখণ্ড আন্দোলনে জড়িয়ে পরেছেন। আলাদা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবীতে বারবার সোচ্চার হয়েছেন। "Uttarakhand Solidarity Network " প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিভিন্ন তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে উত্তরাখন্ডকে তুলে ধরেছেন।
"Where no journeys End" নামক ডকুমেন্টারির জন্যে শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফারের জাতীয় পুরষ্কার পান। উল্লেখ্য, এই ডকুমেন্টারির জন্যে তিনি Houston International Film Festival এ পুরষ্কৃত হন। "The splendour of Garhwal and Roopkund" নামক তথ্যচিত্রের জন্য তৃতীয়বার জাতীয় পুরষ্কারে ভুষিত হন।
শুধু উত্তরাখন্ড নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতেও বিভিন্ন জনসেবামূলক কর্মকান্ডের সাথে তিনি যুক্ত। সম্ভবত এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই তাঁর সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ, কিন্তু তা তেমন সাফল্য পায়নি।
এমন একজন অসামান্য ব্যক্তিত্বকে কি বাঙালি তাঁর প্রাপ্য গুরুত্ব, মর্যাদাটুকু দিল?বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও ভিক্টরকে সেভাবে ব্যবহারই করল না। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায়, সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান অন্য অনেকের চেয়ে বেশী।
সম্প্রতি আর্জেন্টিনীয় পরিচালক পাবলো সিজার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন। রবীন্দ্রনাথের ভুমিকায় সেই ভিক্টর ব্যানার্জি। আমাদের আরো ঋদ্ধ করুন ভিক্টর। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।